বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আত্মজীবনি পড়া শেষ করলাম। তার নিজের হাতে লেখা ও তার মেয়েদের হাতে সম্পাদিত বইটিতে তার রাজনৈতিক জীবনের প্রথম দিকের দিনলিপি এখানে তিনি তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছেন । তার লেখার ভঙ্গি অনেকটা গল্পের মতন; একটু যেন সৈয়দ মুজতবা আলির স্টাইলটা আসে । আড্ডার আমেজ আছে ; অতটা যদিও সরস বর্ননা নয়, তবে পরের অনুচ্ছেদটা পড়তে ইচ্ছা করে। শেখ মুজিব বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচে উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব।তার মানসজগতের পরিচয়ের খোজ নেবার ইচ্ছা বাঙালির হতেই পারে। আমিও তার ব্যতিক্রম নই । এই বইয়ের ঘটনাবলি ১৯৪৩ থেকে ১৯৫৫ সময়কার । তখনো আইয়ুব খান ক্ষমতায় আসেন নি। ইস্কানদার মির্জা মাত্র দৃশ্যপটে হাজির হচ্ছেন।
শেখ মুজিবের শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে তেমন একটা ধারনা পাওয়া যায় না এই বইতে। তার নিজের লেখাতেও তিনি শহীদ সোহরাওয়ার্দির ছায়ায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছেন প্রায়ই; তবে সংগঠক হিসবে তিনি যে অসাধারন তার লেখাতেও তা স্পষ্ট। ১৯৪৩ এ যখন মুসলিম লীগকে অভিজাতদের ড্রয়িংরুম থেকে বের করে রাজপথে নামানো হচ্ছে তার মূল পরিকল্কপক সোহরাওয়ার্দী আর কর্মী এই শেখমুজিব। সেই মুসলিম লীগ যে অবিভক্ত বাংলায় সরকার গঠন করল তার পেছনে তার অসামান্য অবদান তার। ১৯৪৯ সালে মুসলিম লীগের মেরুদন্ডহীন শীর্ষ নেতারা যখন নবগঠিত রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়ে একের পর এক পাঞ্জাবি আমলাদের হাতে দেশ তুলে দিচ্ছিলেন। তখন একটি বিরোধি দলের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। দেশপ্রেমিক মুসলিম লীগের নেতারা তখন কোনঠাসা ক্ষমতায় থাকা নেতাদের কাছে। তাদের নিয়ে ভাসানির সভাপতিত্বে গঠন করা হল আওয়ামী লিগ। এই দলটাও গুছিয়ে দিলেন মূলত শেখ মুজিব। আওয়ামী লিগের ভাসানি আর কৃষক প্রজা পার্টির ফজলুল হক বার্ক্যধজনিত কারনে চারিত্রিক দৃঢ়তা দেখাতে পারছেন না। আজ এক বলছেন তো কাল আরেক কথা বলছেন।দল প্রতিদিন ভাঙে আর গড়ে। শেখ মুজিব তাদের দুজনের উপর বিরক্ত কিন্তু একবারও মুখের উপর কিছু বলছেন না। তার সততা আর স্পষ্টবাদিতার জন্যই তাকে মানুষ বিশ্বাস করত। আর নিজে বড় সরকারি পদে না থেকেও সরকারে যাবার জন্য শেখ মুজিবকে দিয়ে মানুষের আস্থা অর্জন করিয়ে নেয়াটা তখনকার বড় নেতাদের জন্যও অনেকটা অপরিহার্য ছিল। পার্টির হয়ে সভা করছেন, জনগনের কাছে কখনো আওয়ামিলীগের বক্তব্য তুলে ধরছেন, কখনো যুক্তফ্রন্টের যৌক্তিকতা; আর দুদিন পর পর জেলে ঢুকছেন। দ্বিগুন জনপ্রিয়তা নিয়ে আবার বের হয়ে আসছেন। এই অসমাপ্ত আত্মজীবনিতে এর চে বেশি খুব একটা ইনফরমেশন নেই ।
প্রথম ৭৫ পৃষ্ঠা উঠতি রাজনীতিকদের জন্য কাজে লাগতে পারে।এই অংশেই মূলত তিনি এলাকার মানুষের জন্য কাজ করতে করতে তাদের মানুষ হয়ে উঠছেন। একটা সমাজের নেতা হতে হলে সেই সামাজের একজন হতে হয়। শেখ মুজিব সেটা হয়ে উঠেছিলেন মূলত তার স্কুল জীবনেই। তবে এই অংশে যে ভাষায় তিনি হিন্দু বাড়ির লোকজনের মানসিকতার সমালোচনা করেছেন এই যুগে হলে তাকে মৌলবাদি ট্যাগ খেতে হত সন্দেহ নাই। অবশ্য পার্টিশনের পরে এই প্রতিবেশিদের যেন দেশ ছাড়তে না হয় তার জন্যে নিজেই অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন।
জেলে বসে শেখ মুজিব এই ডায়রি লিখছেন। ডায়রীর শেষ দুই তৃতীয়াংশে প্রতিটা ঘটনার বর্ননায় মুসলিম লিগের প্রতি তীব্র সমালোজনা ছুড়ে দিচ্ছেন। মুসলিম লীগ আমলা নির্ভর হয়ে যাচ্ছে, গভর্নর জেনারেল সব ক্ষমতা নিয়ে নিচ্ছে, বিরোধি দলকে সহ্য করা হচ্ছে না, বিরোধি নেতাদের নিরাপত্তা আইনের অজুহাতে জেলে ভরা হচ্ছে। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে মুসলিম লীগের যেসব আচরনের সমালোচনা তিনি নিজে করছেন ঠিক একই আচরন তিনি নিজে করেছেন ৭২ থেকে ৭৫ অব্দি। শেরে বাংলা আর ভাসানির উপর ঠিক যে কারনে তিনি বিরক্ত হচ্ছেন তেমনি তার আচরনে বিরক্ত হচ্ছেন তাজউদ্দিনেরা।
ড. জাফর ইকবাল যেভাবে বইটির প্রশংসা করেছেন ততটা প্রশংসা পাবার মতন জিনিস এইটাকে আমার মনে হয় নাই। প্রথম কথা- বইটা অসম্পূর্ন। এবং এটা থেকে বঙ্গবন্ধুর পরিনত বয়সের রাজনৈতিক দর্শনের কোন খোঁজ পাওয়া যায় না । যে বিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপকার হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছিলেন তার শুরুর সময়টার কিছু ধারনা পাওয়া যাবে মাত্র। তবে প্রথম ৭৫ পৃষ্ঠা উঠতি রাজনীতিকের চিন্তা জগতের বাড়ির লিভিংরুম হতে পারে।
September 15, 2015
0 comments:
Post a Comment