মে মাসের শেষ সোমবার মেমোরিয়াল ডে তে মার্কিনিরা এযাবত সব যুদ্ধে নিহত সেনা সদস্য দের স্মরণ করে। এইজন্যে সরকারিভাবে ১ দিনের ছুটি থাকে । Weekend এ শনিবার, রবিবার মিলিয়ে ৩ দিন। এইরকম ৩ দিনের ছুটিকে এদেশে সাধারন মানুষ বলে "Long weekend"। বুদ্ধিমানেরা শুক্রবার ঐচ্ছিক ছুটি নিয়ে একে "Longer weekend"বানিয়ে ফেলে। প্রতিবছর এই কাজটা আমিও করি। দুই ঈদের নামাজের মতন মেমোরিয়াল ডে আর লেবার ডে তে বেশ বড়সর দুইটা রোড ট্রিপ দেওয়া একটা ধর্মীয় আচারের মতন হয়ে দাড়িয়েছে আমার জন্য। গত বছর এই সময়টাতে গিয়েছিলাম প্রশান্ত মহাসাগরের পাড় ঘেষে ছুটে চলা প্যাসিফিক কোস্ট হাইওয়ে ধরে। এখনো পর্যন্ত আমার জন্য "Best road trip ever" । এবারের প্লান রকি পর্বতমালা। তিনগোয়েন্দার রকি বিচের ধারের রকি নয়। এই পর্বতমালার সবচে সুন্দর অংশ নাকি কানাডায়। আর সেখানেই আমাদের নিয়ে যাবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বন্ধু আফজাল হোসেন রূপক। সিনসিনাটি থেকে আমি আর তাপস; ভাঙ্কুবার থেকে আসছে রুশদী সুপ্তি আর য়ারা।
প্রস্তুতি হিসেবে কানাডার ভিসা নেওয়া হয়েছে ফেব্রুয়ারীতেই। ভিসা প্রসেস আমেরিকার ভিসা প্রসেস এর মতন খুব একটা সহজবোধ্য নয় , একটু যেন বিরক্ত লাগে এত এত ডকুমেন্ট একাধিকবার আপলোড করতে হয় বলে। aplication এক জায়গায় তো aplication fee আরেক জায়গায়। দুর্বোধ্য আরো অনেক নিয়ম কানুনের বালাই। তার উপর নিজেও করেছি ভুল। ভিসার আবেদন পত্রে নাম ধাম পেশা এইসব ইংরেজির পাশাপাশি মাতৃভাষাতেও লেখা নিয়ম। আমি বেখেয়ালে শুধুই ইংরাজিতে ফর্ম ফিলআপ করে বাড়তি টেনশনের ব্যবস্থা পাকা করেছি। অবশ্য ৬ মাসের ভিসা চেয়ে বেলাশেষে ৪ বছরের মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা পেয়ে বিরক্তি মুছে গিয়ে দিল খুশ হয়ে গেল।
সিনসিনাটি থেকে রেজাইনা পর্যন্ত দুরত্ব পাড়ি দিচ্ছি ডেল্টা এয়ারলাইন্স এর বিমানে চেপে । মিনিয়াপলিস এ ছোট্ট বিরতি। এর বিপ্রতীপ ক্রমে পাড়ি দেয়া হবে ফিরতি পথটাও। মাঝখানে ৩ দিনে রেজাইনা থেকে গাড়িতে চেপে ঘুরে আসব "কানাডিয়ান রকিস"এর বিখ্যাত "বান্ফ মেমোরিয়াল পার্ক"।
বিমানসূচি :
Thu, 21MAY | DEPART | ARRIVE | ||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|
|
|
| ||||||
|
|
| ||||||
Mon, 25MAY | DEPART | ARRIVE | ||||||
|
|
| ||||||
|
|
|
আমাদের প্রথম লে ওভার মিনিয়াপলিস , দের ঘন্টার মত লম্বা উড়াল ভ্রমন। মাঝখানে জানালা দিয়ে একসময় দেখা গেল লেক মিশিগান -
বলার মতন কোনো ঘটনা ছাড়াই পৌছে বিমান পৌছে গেল রেজাইনা এয়ারপোর্ট। ইমিগ্রেশন অফিসার কোথায় যাবা , কয়দিন থাকবা , এইসব কিছু প্রশ্ন করে ছেড়ে দিল। আজ পর্যন্ত ৪ টা দেশের ইমিগ্রেশন অফিসার দেখলাম। কানাডার রেজাইনা এয়ারপোর্ট এর ,মতন এত দ্রুত অভিবাসী নিকাশঘর আগে কোথাও দেখি নাই।
এয়ারপোর্ট থেকে বের হলে সবসময় ই যে ব্যাপারটা ঘটে সেটা হচ্ছে ওয়েদার শক। নতুন দেশের নতুন আবহাওয়া এবং তাপমাত্রা। সিনসিনাটি থেকে যখন রওনা দেই তখন সেখানে তাপমাত্রা ছিল ৫৭ ° ফা। ধরেই নিয়েছিলাম রেজাইনা তে ৪০ কি ৪৫ তো হবেই। শক খেলাম পুরাই উল্টা দিক থেকে। রেজাইনার তাপমাত্রা তখন ৭৫ ° ফারেনহাইট।
সকালে সনিকে অফিসে দিয়ে এসে আমরা তিনজনে বের হলাম রেজাইনার পার্লামেন্ট এর পাশে হাটতে। সেখানে বেশ সুন্দর চেরি ফুটেছে।
রেজাইনা থেকে বান্ফ গাড়িতে ৮ ঘন্টার দুরত্ব। পথের জন্য কিছু snacks, বান্ফ এ গিয়ে বার বি কিউ এর জন্য প্রস্তুতি, আর মলে গিয়ে কিছু উপহার সামগ্রী কিনে দুপুর পার করে দেয়া হলো। বাসায় ফিরে রূপকের স্পেশাল খিচুড়ি ।
অতঃপর যাত্রা বান্ফের পথে। সনিকে অফিস থেকে তুলে নিয়ে দীর্ঘ ৮ ঘন্টার ড্রাইভিং। রূপক একাই করলো। ক্যালগেরি শহর পার হতেই একটু একটু করে রকি মাউন্টেন উকি মারতে থাকে। একসময় প্রকান্ড সব পাহাড় পর্বতেরা সার বেধে দাড়িয়ে যায় পথের দুপাশে। আমাদের আপাত গন্তব্য ক্যানমোর শহর। পৌছুতে বেজে যায় রাত দশটা।
পরদিন সকালে লজের ব্যালকনি থেকে পাহাড়কে পেছনে রেখে তোলা আমাদের এই ছবিটা জায়গা পেতেই পারে এইখানে।
কফির জন্যে আমেরিকায় যেমন আছে স্টারবাকস কানাডার আছে টিম হর্টনস। সকালের প্রাতরাশ আর কফি চলল এক দফা সেখানে।
কফির পর সালফার মাউন্টেন। এখানে হাইক করে উঠা যায় ৫.৫ কিলোমিটার ট্রেইল, এলিভেশন গেইন অবশ্য মাত্র ৬৫৫ মিটার। আমাদের সবার হাইক করার সামর্থ্য বা পর্যাপ্ত ইচ্ছাশক্তি নেই তাই মাথা প্রতি ৪০ ডলার খরচ করে কেবল কার নেয়া হলো। চূড়ায় অবশ্য সিড়ি বাধানো পথ আছে। সেখান থেকে চার পাশের উপত্যকার নৈসর্গ উপভোগ করা যায়।
ঘন্টা খানেক পর আমরা রওনা দেই লেক লুইস এর পথে। ২০ মিনিট কি আধা ঘন্টার দুরত্ব হবে সালফার মাউন্টেন থেকে। এখানে মে মাসের শেষ সপ্তাহে এসেও বরফ মাত্র গলতে শুরু করেছে । আর কদিন পরে এলেই কায়াকিঙ করা যেত অনায়াসে। সমুদ্র সমতল থেকে ১৭৫০ মি (৫৭৪১ ফুট ) উচ্চতায় এখানে পানি জলজ শৈবালের কারণে turquoise নীল্ বর্ণ ধারণ করে আছে।
কাছেই আবার ২০ মিনিটের দুরত্বে আছে মোরেন লেক। সেটা আরেকটু উচুতে ১৮৮৪ মি (৬১৮১ ফুট) এখানে বরফ আরেকটু বেশি। মোরেন লেক এর ভিস্তা পয়েন্ট এ দাড়ালে পাশের ১০ টা চূড়াকে একসাথে দেখতে পাওয়া যায়। সুপ্তি অবশ্য গুনে ৮ টা পেয়ে বেশ আপসেট। নিচের প্রথম ছবিটা মোরেন লেক এর। পরেরটা ভিস্তা পয়েন্ট থেকে নেমে আসা পথের।
এই লেক গুলোর সবাইকে একটার সাথে আরেকটাকে যুক্ত করেছে 'বো রিভার ' নামের একটা নদী। এই বো রিভার এর এখানে সেখানে আছে বেশ কয়েকটা জলপ্রপাত। তারই একটা 'বো ফলস' আমাদের পরের গন্তব্য।ছবির বাম পাশের পার্কে মানুষ প্রকৃতি দেখতে আসে আর ডান পাশের পাহাড়ের উপর আসে ক্যাম্পিং করতে।
বো ফলস এর পাশেই পর্যটক দের অর্থ কড়ি খসানোর জন্য একটা শপিং এরিয়া সহ ছোট শহর আছে। বিকালটা শহর ঘুরে , কফি - স্মুদি খেয়ে পার করে দিলাম। পথের পাড়ে বেঞ্চে বসে সর্বনাশ করে দিল শরণ। মেঘদলের রোদের ফোটা খালি গলায় গেয়ে মাথার ভিতর ঢুকিয়ে দিল। এর পর প্রায় সপ্তা দুয়েক ধরে মাথার ভেতর শুধু ঘুরছে
"শোনো কবি ! শোনো কবিতা !!
ভাঙ্গো দীর্ঘ মূর্ছনা
রাখো এইখানে হাত টুকু
তবু চলে যেতে বোলোনা !"
বো রিভার থেকেই আমরা আবার আমাদের লজে ফিরে যাই। সোফায় শরীর এলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পরে কেউ , কেউ খাটে। রুশদী আমি আর তাপস আজাইরা গ্যাজাইতে থাকি অনেক রাত পর্যন্ত। একটার পর একটা ট্রেন ছুটে যায় আমাদের লজের পেছনের রেলপথ বেয়ে।
একসময় আমাদেরও তেল ফুরোয়। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাক্স পেটরা গুছিয়ে যার যার রাস্তা মাপতে থাকি। বিদায়ের সময়টা আমি সবসময় সংক্ষিপ্ত রাখতে চাই। এর যেন কোনো স্মৃতি না থাকে।
(শেষ )
জুন ৪ ২০১৫, সিনসিনাটি, ওহাইও
0 comments:
Post a Comment