memorial day weekend এ গত বছর মার্কিন মিড ওয়েস্ট এর ৫ টা নতুন স্টেট ঘুরে দেখেছিলাম - মিসৌরি কানসাস নেব্রাস্কা আইওয়া উইসকনসিন। এবার সেরকম কিছু একটা করার প্লান ছিল। কথায় কথায় সামি আর তাপস এর সাথে ঠিক করলাম pacific coast highway টা ড্রাইভ করে ফেললে কেমন হয়? যেই কথা সেই কাজ ২ দিনের মাথায় সিনসিনাটি থেকে ওয়াশিংটন আর সান ডিয়েগো থেকে সিনসিনাটির ওয়ান ওয়ে টিকেট করা হলো। দুই দেশের আর বন্ধুদের জানানো হলো প্লান এর কথা যাতে তারা যোগ দিতে পারে। যদিও জানাই ছিল কেউ পারবে না। রুশদি আর সুপ্তি ভাঙ্কুবার থাকে । সীমান্তের ওপার থেকে ড্রাইভ করে চলে আসবে ওরা। একদিন ওয়াশিংটন এর জন্য রেখে বাকি ৩ দিন PCH এর জন্য বরাদ্দ। সেই মত অফিস থেকে শুক্রবার ছুটি ও নেয়া হলো।
বুধবার রাতে CVG থেকে উড়ল আমাদের নিয়ে চলা বিমান। ডালাস হয়ে পৌছুলাম ওয়াশিংটনের সিয়াটল এর পাশে ছোট্ট শহর Tukwila তে। বন্ধু রুশদী-সুপ্তি আর ওদের মেয়ে য়ারা কে নিয়ে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল। য়ারার সঙ্গে আমাদের প্রথমবারের মত দেখা হলো।
পরদিন বিকাল পর্যন্ত ওয়াশিংটন ডাউনটাউন এর এগলি ওই গলি হেটে বেড়ালাম আমরা। ফার্মার্স মার্কেট আছে একটা সিয়াটল এ বাংলাদেশের কাচা বাজারের মত অনেক টা। সকালে ব্রেকফাস্ট সেখানেই সারা হলো। দুপুরে কাছের একটা বাংলাদেশী দোকানে লাঞ্চ সেরে বিদায় নিল রুশদী-সুপ্তি পরিবার। আমরা রবনা দিলাম cape disappointment এর বাতিঘর দেখতে এই পথেই আমাদের প্রশান্ত মহাসাগরের তীর ঘেষে দেড়হাজার মাইল এর road trip শুরু হলো।
Cape Disappointment State Park এ ২ টা বাতিঘর। ১৮৫৬ সালের Cape Disappointment lighthouse মোহনার খুব কাছে থেকে না হলে গভীর সাগর থেকে দেখা যেত না। অনেক জাহাজ তীরের কাছে খাড়িতে উচু পাথরে ধাক্কা খেয়ে ডুবে গিয়েছিল। এমনকি Cape Disappointment lighthouse তৈরির জন্য যে জাহাজ মালপত্র বয়ে নিয়ে আসছিল সেটাও সাগরে ডুবে গিয়েছিল। তাই একটু উত্তরে ১৮৯৭ সালে ২য় বাতিঘর প্রতিষ্ঠা করা হয় যার নাম Northhead Lighthouse. আমরা অবশ্য প্রথমে গিয়েছিলাম Northhead এ। পার্কিং লট এ পৌছে পাশে চোখে পড়ল এই মেঠো পথটা তখন ওই পাশে সাগরের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। পথ ধরে একটু একটু করে এগিয়ে যাই। প্রশান্ত মহা সাগর একটু একটু করে এগিয়ে আসে আমার দিকে । থুক্কু আমি একটু একটু করে এগিয়ে যাই প্রশান্ত মহা সাগরের দিকে । এই মেঠো পথের ঢাল বেয়ে নেমে গেলেই অসীমতা ... ওয়াশিংটন উপকূল আমার প্রথম প্রশান্ত মহাসাগর দর্শনের সাক্ষী হয়ে থাকলো।
সাগর থেকে ২০০ ফুট মতন উপর দিয়ে হাটাপথ ধরে আমরা হেটে গেলাম বাতিঘরের কাছে। চোখ সবসময়ে সাগরের দিকে অস্তমান সুর্য দিগন্তের পানে ছুটছে । একটু আলো চুরি করে নিয়ে আকাশ আর সমুদ্রতে মিশিয়ে দেয়ার চেষ্টা করি কামেরা দিয়ে।
নর্থ হেড বাতিঘর -
এখানথেকে ২ য় বাতিঘর প্রায় ১.৫ মাইল। ১ মাইল ড্রাইভ করে ০.৫ মাইল হাটা পথ। পথে একটু ভুল করে আমরা মূল বাতিঘর থেকে সরে গেলাম। যাই হোক একটু পাশ থেকে দেখা সেই বাতিঘর ও নয়নাভিরাম। এটাই হতাশার বাতিঘর। ১৮৯৭ সালের আগে পর্যন্ত অনেক জাহাজ এই বাতিঘর খুঁজে নাপেয়ে সাগরের উথাল পাথালে সাগরে হারিয়ে গেছে। আর তাই এর নাম হযেছিল হতাশার বাতিঘর।
এটাই ওয়াশিংটন স্টেট এ সাগর পাড়ের শেষ দর্শনীয় স্থান। আমরা এবার চলতে থাকব অরেগনের সৈকত ধরে।
অরেগনে আমরা থামব haystack পাথরের কাছে। প্রশান্ত মহাসাগরের তীর জুড়ে খড়ের গাদা আকৃতির বিশাল সব পাথর ছড়িয়ে আছে; এদেরকে haystack rock (বা খড়ের গাদা পাথর ) বলে। এর মধ্যে অরেগনের এই পাথরটা নাকি আমেরিকার সবচে বড় (উচ্চতা ২৩৫ ফুট)। আর পরিসংখানের হিসাবে এই পাথর হচ্ছে ওরেগন অঙ্গরাজ্যের সবচেযে পর্যটক প্রিয় ফটো অবজেক্ট । প্রতিবছর দুই লক্ষ পর্যটক এই পাথর দেখতে ক্যানন বিচ এ বেড়াতে আসে। ভাটার সময় পানি নেমে গেলে পায়ে হেঁটে যাওয়া যাও এর কাছে।
অরেগন এর সাগরের তটরেখা বরাবর Pacific Coast Highway -
অরেগনের সমুদ্র সৈকত ... সীল রক এলাকা। ..সাগরে ছোট ছোট haystack রক যেগুলো মাথা চোখা ওগুলোকে বলে needle .
এখানেও পথে প্রায়ই বাতিঘর চোখে পড়ছিল।
সীল মাছ ...সাগর সিংহের দল । টি ভি তে অনেক সুন্দর দেখালেও বাস্তবে দেখতে ততটা সুন্দর নয়। তবে সাগরে এদের ডিগবাজি দেখতে বেশ লাগে ।
এই পথ ধরে নেমে গেলে অনেক কাছ থেকে সী লায়ন দেখা যাবে -
পোর্ট অরফোর্ড এর সৈকত ...এত নীল তার মোহনীয়তার চরমে ; ভাষায় তো দুরের কথা ছবিতেও বর্ননা করা কঠিন ...
অরেগনের শ্যামশোভা
রাস্তার দুপাশজুড়ে রেডউড গাছের ভাইবোনেরা অভিবাদন জানাচ্ছে - ক্যালিফোর্নিয়ায় স্বাগতম।
কালিফর্নিয়াতে আমাদের প্রথম গন্তব্য এভিনিউ অফ জায়ান্টস। পৃথিবীর বৃহত্তম উদ্ভিদ প্রজাতির আবাসস্থল হাইওয়ে ১০১ এর পাশ দিয়ে Humboldt Redwood State Park এর ভেতর দিয়ে ৩১ মাইল দীর্ঘ রাস্তা যার দুইপাশ জুড়ে পৃথিবীর বৃহত্তম গাছের এখনো নিজেদের রাজত্ব চালিয়ে নিচ্ছে। এখানে ৩০০ ফুটের চেয়েও বেশি উছু গাছ আছে প্রায় ১৫০ এর মত। এরা পৃথিবীতে জীবিত সবচে প্রাচীনতম গাছ বললে মনে হয় অত্যুক্তি হবে না। এদের অনেকের ই বয়স ১৫০০ বছরের ও বেশি -
এভিনিউ অফ জায়ান্টস
ক্যামেরার লেন্সে আঁটছে না বিশাল রেডউড। পাশের ছোট্ট অবয়ব টা আমি নিজে।
গাছের বয়স হিসাব করা হয় তার বর্ষবলয় দেখে। বয়সের সাথে সাথে গাছের গুড়ি চূড়া হতে থাকে আর একটা করে নতুন বর্সবলয় যোগ হতে থাকে। পার্কের বিভিন্ন জায়গায় এরকম বয়স্ক গাছের কান্ড রাখা আছে। একটার গায়ে দেখলাম বর্ষ বলয়ের সাথে সাথে ওই সময়ের পৃথিবীর ইতিহাসের এক একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সময় কাল উল্লেখ করা আছে। ভাইকিংদের আমেরিকায় পদার্পন, চেংগিস খানের হাতে বাগদাদ ধ্বংস, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ - কত জানা অজানা ঘটনাই না ঘটেছে এই গাছটার জীবদ্দশায় বেচারা নিজে হয়ত তা জানত ও না।
আমরা এভিনিউ অফ জায়ান্টস থেকে বের হয়েছি যখন, তখন বাজে প্রায় সন্ধ্যা সাতটা। এবার আমাদের যাত্রা সান ফ্রান্সিসকোর পথে। তাপসের হাতে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে আমি দেই ঘুম। ঘুম থেকে উঠে সানফ্রান্সিসকোর অদূরে অকল্যান্ড শহরের এক মোটেলে গিয়ে আবার বিছানায় ঘুম। দুপুরে থাই রেস্টুরেন্টে ব্যাপক খাওয়াদাওয়ার জোরে রাতের খিদে পাত্তা পায় নি আর।
ঘুম ভেঙ্গে উঠে দেখি সামি সানফ্রান্সিসকো শহর ঘুরে দেখার প্লান রেডি করে ফেলেছে। সেই মত আমরা সকালের নাস্তা সেরে নিয়ে অকল্যান্ড থেকে ফেরি ধরলাম। সানফ্রান্সিসকো বে এর উপরদিয়ে করে এসে মূল শহরে এসে পৌছুলাম সকাল ১০ টা নাগাদ। এরপর হেটে গোল্ডেন গেট ব্রিজ। পথে সানফ্রান্সিসকোর শহর মানুষ জন সব এ দেখা হলো।
ফেরি থেকে দেখা সান ফ্রান্সিসকো শহর -
(কু?)খ্যাত আলকাতরাজ বন্দীশালা ( ফেরী থেকে দেখা )
সান ফ্রান্সিসকো শহরের পথ ঘাট
পথের পাশেই সরাইখানা জমে উঠেনি তখনো
সান ফ্রান্সিসকো শহর ঘুরে দেখার জন্য খুব ভালো একটা অপশন হচ্ছে বাইসাইকেল। অনেক টুরিস্ট ই বাইক রেন্ট করে নিয়ে শহরময় ঘুরে বেড়ান।
উপসাগরের সৈকতের একটা প্রবেশপথ। ওপাশে অসংখ্য মানুষের সমাগম।
ইস্পাতের শিল্প কর্ম। কুকুর শাবকের অবয়ব।
সান ফ্রান্সিসকো তে ফেরি ঘাট থেকে গোল্ডেন গেট পর্যন্ত হাটা রাস্তা র পাশে মাঝে মাঝেই সার বাধা বাড়ি ঘর আর পাম গাছ।
গোল্ডেন গেট ব্রিজ -- 1937 সালে নির্মিত এই সেতুর একপাশে প্রশান্ত মহাসাগর অার একদিকে সান ফ্রান্সিসকো বে । সেতু নিয়ে একটা মজার তথ্য দেই । এই এলাকার বাতাসে করোসিভ উপাদানের পরিমান এত বেশি যে এই লোহার সেতু একপাশ থেকে রঙ শুরু করে যতদিনে অন্যপাশে শেষ হয় ততদিনে প্রথমপাশ থেকে আবার রঙ করা শুরু করতে হয় (তথ্যসূত্র: সামি)।
গোল্ডেন গেট থেকে আমরা বাসে চেপে ফেরি ঘটে পৌছাই। সেখান থেকে ফেরি নিয়ে আবার অকল্যান্ড। সেখান শেষ হয় আমাদের সান ফ্রান্সিসকো ঘুরে দেখা। একটা আফগান খাবারের দোকানে দুপুরে খেয়ে নিয়ে আবার দক্ষিনদিকে যাত্রা শুরু। গন্তব্য বিগ সুর হয়ে সান ডিয়েগো।
প্রশান্ত মহাসাগরের ধার ঘেঁষে আবার যাত্রা। বিগ সুর এর পথে - কখনো সমুদ্র থেকে কয়েকশো ফুট উপরে -
কখনো সৈকতের প্রায় ধার ঘেঁষে
এরকম অনেক পাহাড়ি সেতু আছে পুরো রাস্তা জুড়ে -
এই ছবিতে একটা ব্রিজ আছে। দূর থেকে দেখে Bixby Bridge মনে হলেও আসলে তা নয়।
বিক্সবি ব্রীজ এলো আরেকটু পর । এলাকার অন্যান্য সেতুর সঙ্গে এর তেমন কোন পার্থক্য নেই তবে ট্যুরিস্টদের কাছে এই ব্রীজটাই এখানকার সবচে জনপ্রিয় ফটো অবজেক্ট।
বিক্সবি ব্রীজ পার হবার পর বিগ সুর এলাকায় সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসে একটু একটু করে। রাস্তার বাঁকগুলো আরো চোখা হতে শুরু করে। গতিসীমা ২৫ কোথাও ৩৫ কোথাও। আমাদের Hyundai Sonata র ম্যানয়ভারিং এর উপর আস্থার প্রমান স্বরূপ স্পীডিং করতে সাহস হয় না। চোখ আর মাথার উপর প্রচন্ড চাপ। একপাশে খাড়া ঢাল বেয়ে নিচে বিশাল জলরাশি । অন্যপাশে উচু পাহাড় আর জঙ্গল। সান ফ্রান্সিসকো থেকে আমরা তখন প্রায় ২৫০ মাইল দূরে । আঁধারে একটু বেখেয়াল হলে মহান সলিল সমাধি। রাস্তার ধারে মাঝে মাঝে পর্যটকদের ক্যাম্প/তাঁবু । এছাড়া আশে পাশে শত মাইলের মধ্যে নেই কোন শহর বা বড় কোন হাইওয়ে।
দুপুর দু'টার দিকে সান ফ্রান্সিসকো থেকে শুরু করেছিলাম। বিগসুর এর এবড়ো থেবড়ো এলাকার ভিতর দিয়ে সাপের মত ড্রাইভ করে করে ক্লান্ত সামি । পথে একটা ছোট গ্যাস স্টেশনে গাড়ি থামায়। কে জানে কতদূরে কতপরে আবার সুযোগ পাওয়া যাবে। জলবিয়োগ করে হস্তপদ প্রক্ষালন- বিস্তারন পূর্বক আবার রাস্তায় নামি।
আমার ডান পাশে এখনো সমুদ্র। তবে এখন তাকে আর দেখা যাচ্ছে না। আঁধারের একপাশে আবছা ভাবে পাহাড় আর অন্যপাশে শূন্যতাই সমুদ্র। দশ বারো মাইল পর রাস্তার বাঁক স্বাভাবিক হতে শুরু করে। সান্তা বারবারার কাছাকাছি চলে আসছি একটু একটু করে । সে ও প্রায় ২০০ মাইল দূরে। রাস্তায় গাড়ি নেই তেমন। এখন ছুটছি গতিসীমার প্রায় ১৫/২০ মাইল উপরদিয়ে। রাত নেমে যাওয়ায় আর ছবি তোলা হয়নি এখানে।
সান্তা বারবারা পেরিয়ে লস এঞ্জেলেস এর কাছাকাছি এসে দেখি রাস্তায় প্রচুর গাড়ি।মোটামুটি সবাই ৮০ মাইল/ঘন্টায় ছুটছে। গতি বাড়িয়ে দেই আমিও। সেই দুপুর ২টা থেকে আমরা পালা ক্রমে ড্রাইভ করছি। সান ডিয়েগোতে পৌছে হোটেলের বিছানা আর আমার ক্লান্ত শরীর ; মাঝের মাইলগুলোকেই সবচে বড় শত্রু মনে হচ্ছে। ঝড়ের বেগে শত্রুবাহনী কচুকাটা করতে করতে সান ডিয়েগো পৌছুতে বেজে গেলো রাত ২টা।
পরদিন সকাল ১০টায় আমাদের ফিরতি ফ্লাইট।
0 comments:
Post a Comment