Tuesday, February 4, 2014

2014 বিল গেটস এর চিঠি : [GATES 2014: Annual Letter]

Posted by

যেকোনো  হিসেবেই পৃথিবী আগের যেকোনো সময়ের চে ভালো আছে। মানুষ সুস্থভাবে  অপেক্ষাকৃত বেশিদিন বাঁচছে। এক সময়ের বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভর অনেক দেশই এখন স্বনির্ভর। আপনি হয়ত  ভাবছেন এরকম তাক লাগিয়ে দেয়ার মত উন্নতি ধুমধাম করে  উদযাপন করা উচিত; বরং মেলিন্ডা আর আমি অবাক হই এটা দেখে যে, এখনো কত মানুষ ভাবে যে পৃথিবীর অবস্থা দিন কে দিন খারাপ হচ্ছে। পৃথিবীর দারিদ্র্য আর অসুখ-বিসুখ দূর করা অসম্ভব এমন ধারণা করা শুধু ভুলই  নয় , বিপদজনকও বটে। আর তাই এবছর আমরা এরকম কিছু মিথ ( ## প্রতিষ্ঠিত ভ্রান্ত ধারণা ) নিয়ে ভিন্ন আংগিকে ভেবে দেখছি। আশা করছি পরেরবার এরকম মিথ এর মুখোমুখি হলে আপনিও তাই করবেন ।




-- বিল গেটস

মিথ ১
আরোপিত দারিদ্র
POOR COUNTRIES ARE DOOMED TO STAY POOR

অনেকের মুখেই আমি অনেক জায়গার ব্যাপারে এরকমটা  শুনেছি। বিশেষভাবে বলতে আফ্রিকার ব্যাপারে। ওয়েব এ আপনি খোজাখুজি করলে এরকম নামকরণসহ অসংখ্য হেডলাইন আর বই পাবেন যেমন -"কিভাবে ধনী দেশ গুলো ধনী হচ্ছে আর কেন গরিব দেশগুলো গরিব থেকে যাচ্ছে  ". ভাগ্যক্রমে এইগুলো বেস্টসেলার নয়। কারন  গোড়াতেই যে গলদ। বরং সত্য হল এই যে আফ্রিকা সহ সব দেশে দিনে দিনে উপার্জন আর মানব সমাজের উন্নয়নের অন্যান্য মানগুলো উন্নততর হচ্ছে।

তারপরও এই ধারনাটা কিভাবে এত গভীরে প্রবেশ করতে পেরেছে?

আফ্রিকা প্রসংগে একটু পর আসছি। তার আগে সার্বিক বিশ্ব পরিস্থতির দিকে একটু দেখা যাক, অর্ধশতাব্দি পিছন থেকেই শুরু করা যাক। পঞ্চাশ বছর আগে পৃথিবী ছিল তিনভাগে বিভক্ত। আমেরিকা আর তার পশ্চিমা মিত্ররা, সোভিয়েত রাশিয়া আর তার মিত্ররা , আর বাকিরা।আমি জন্মেছি ১৯৫৫ সালে ;বড় হতে হতে জেনেছি তথাকথিত প্রথম বিশ্ব ছিল বেশ উন্নত।এই উন্নত বিশ্বের সবাই স্কুলে গিয়েছে এবং দীর্ঘায়ু হয়েছে। দ্বিতীয় ভাগের দেশগুলো যেন ছিল লৌহপর্দা বেষ্টিত। পর্দার ওপাশ সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যেত না কিন্তু মনে হত ওগুলো অনেক ভয়ংকর জায়গা। আর ছিল তথাকথিত তৃতীয় বিশ্ব- অর্থাত বাদবাকি সবাই। যতটুকু খবর জানতাম এই দেশগুলো ছিল গরীব মানুষে ঠাসা, যেখানে মানুষ স্কুলে যায় না, অল্প বয়সে মারা যায়। সবচে বাজে ব্যাপার, এরা ছিল দারিদ্র্যের ফাঁদে বন্দী যেখান থেকে তারা কখনোই বের হতে পারবে না।






পরিসংখ্যানও সে কথাই বলছে।১৯৬০ সালে বলা চলে পৃথিবীর পুরো অর্থনীতিই ছিল পশ্চিমে। যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রতি উপার্জন ছিল বছরে ১৫০০০ ডলার (অর্থাত‌ ৪ জনের পরিবারে আয় ছিল বছরে ৬০০০০ ডলার)   এশিয়া  , আফ্রিকা , ল্যাটিন আমেরিকায়  এই উপার্জনের মাত্রা ছিল অনেক কম। যেমন ব্রাজিল ১৯৮২ ডলার, চীন ৯২৮ ডলার, বতসোয়ানা ৩৮৩ ডলার ।

 এই দেশগুলোতে  গিয়ে এই দুরবস্থা নিজে দেখার সুযোগ হয়েছিল অনেক পরে। মেলিন্ডা আর আমি ১৯৮৭ তে যখন মেক্সিকো গেলাম , দারিদ্র্যের অবস্থা দেখে আমরা হতবাক। বেশির ভাগ বাড়িতে ছিল না পানির সরবরাহ। মানুষ পায়ে হেঁটে বহুদুর পাড়ি দিচ্ছে এক জগ পানির জন্য। আফ্রিকার গ্রামের পানির জন্য হাহা কারের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল এ দৃশ্য। মাইক্রোসফটের মেক্সিকো সিটি অফিসের একজন কর্মকর্তাকে তার সন্তানদের যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাতে হত পরীক্ষা করিয়ে নিশ্চিত হবার জন্য যে smog এর প্রতিক্রিয়ায় তারা অসুস্থ হয়ে যায় নি।

সেই একই শহরের আজকের অবস্থা চমকে দেয়ার মত। এখানকার বাতাস এখন লসএন্জেলস এর মত (তেমন বিশুদ্ধ না হলেও ১৯৮৭ র তুলনায় অবশ্যই অনেক আশাপ্রদ).  সেখানে এখন আকাশচুম্বি আধুনিক দালান কোঠা, সেতু আর নতুন সব রাস্তাঘাট। যদিও এখনও সেখানে বস্তি আর দারিদ্র্যের ছিটে ফোটা কিছুটা রয়ে গেছে। কিন্তু মোটা দাগে বলতে গেলে এই সব এলাকায় আমি যখন যাই " এখানকার বেশির ভাগ মানুষ এখন মধ্যবিত্ত। কি আশ্চর্য!!"

Mexico city  ১৯৮০ : ২০১১


নাইরোবি বা সাংহাই তেও আপনি একই রকমের পরিবর্তন দেখতে পাবেন।

নাইরোবি ১৯৬৯: ২০০৯



সাংহাই ১৯৭৮:২০১২



এই ছবিগুলোর শক্তিশালী  একটা বার্তা বহন করছে। বৈশ্বিক দারিদ্র্য পরিস্থতি আমার এই জিবিন্কালেই  অনেক বদলে গেছে। তুরস্ক বা চিলির মত দেশের জন প্রতি উপার্জন এখন ১৯৬০ এর সময়ের যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি পৌছে গেছে।পরপরই আছে  মালেয়শিয়া , এমনকি গ্যাবন।  ধনী আর গরীব দেশগুলোর মাঝে যে নো ম্যানস ল্যান্ড ছিল সেটা পূরন করে দিয়েছে ভারত, চীন, ব্রাজিল এবং আরো কিছু দেশ। ১৯৬০ এর সময়ের তুলনায় চীনের মাথা পিছু বার্ষিক উপার্জন বেড়ে হয়েছে ৮ গুন, ভারতের হয়েছে ৪ গুন, ব্রাজিলের ৫ গুন। বতসোয়ানার মত ছোট্ট একটা দেশ তার খনিজ সম্পদকে সুকৌশলো কাজে লাগিয়ে মাথাপিছু উপার্জন বাড়িয়েছে ৩০ গুন। এর মাঝামাঝি অবস্থানে আরও কিছু দেশ আছে ৫০ বছর আগে যাদের অস্তিত্বও  টের পাওয়া যেত না ; এরাও কিন্তু পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক।

দেশের সংখ্যার পরিবর্তে আপনি যদি মানুষ  গুনেন একই চিত্র দেখতে পাবেন ।


তাই দরিদ্র দেশগুলোকে দরিদ্র থাকতে বাধ্য করা হয় এই কথার একটা জবাব হচ্ছে দরিদ্র দেশগুলো আর দরিদ্র হয়ে নেই। 
সব না হোক অন্তত অনেক দেশ - যাদের আমরা গরিব বলতাম - এদের অর্থনীতি এখন অগ্রসরমান। আর  ১৯৯০ এর সময়ের তুলনায় অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা এখন অর্ধেকে নেমে এসেছে। 


এরপরও এখনো পৃথিবীতে অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা প্রায় ১ বিলিয়ন , তাই উত্সবের কথা ভাবার সময় আমাদের এখনো হয়নি। তবে পৃথিবী এতটাই বদলে গেছে যে "উন্নত" বা "উন্নয়নশীল দেশ" শব্দাবলীর প্রয়োজনীয়তা বোধহয় ফুরালো।


যেসব শ্রেণীবিভাগে  চীন এবং কঙ্গো এক কাতারে পড়ে  সেগুলো বরং এই বিভাজনটাকে বরং অস্পষ্ট করে ফেলে। কিছু উন্নয়নশীল দেশ এতটাই এগিয়েছে যে তাদের অনায়াসে উন্নত দেশ বলা চলে। কিছু  ব্যর্থ রাষ্ট্র আছে যারা আদৌ অগ্রসর হচ্ছে না এর বাইরে বেশির ভাগ দেশ ই  আসলে এর মাঝামাঝি  অবস্থান করছে। তাই এখন পৃথিবীর দেশগুলোকে নিম্ন-, মধ্যম - এবং উচ্চ আয়ের দেশ হিসাবে শ্রেণী বিন্যাস করাটা  বেশি যৌক্তিক। (মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে অনেক আরো ২টা দলে ভাগ করে থাকেন নিম্ন মধ্যম - আর উচ্চ মধ্যম ) 


## লেখার এই পর্যায়ে একটা জরিপে প্রশ্ন করা হয়েছে যেসব দেশকে ২০ বছর আগে অর্থ সহায়তা দেয়া হয়েছে তারা এখন আগের চে অনেক ভালো আছে এর পক্ষে অথবা বিপক্ষে ভোট দিন। -- যাতে ৮৯ শতাংশ মানুষ পক্ষে  বলেছেন। ##



উপরের আলোচনা মাথায়  রেখেই আমি এখন এই মিথ এর আরো গভীরতর সংস্করণ এর দিকে আলোকপাত করতে চাই "এশিয়ার বাঘ রা অনেক ভালো আছে মানি , কিন্তু আফ্রিকার কোনো উন্নতি কখনো হয়নি আর হবেওনা "



শুরুতেই বলে নেই, কেউ কিন্তু আপনাকে বলতে পারবে না যে আফ্রিকার দেশ গুলো ৫০ বছর আগেই বরং ভালো ছিল। সাব-সাহারান আফ্রিক়ার মাথা পিছু আয় সময়ের সাথে সাথে বেড়েছে। ১৯৮০র ঋণ সংকটের সময় সেই যে কমতে শুরু করেছিল এরপর ১৯৯৮ থেকে তা আবার ঘুরে দাড়িয়েছে।১৩০০ ডলার থেকে তা এখন প্রায় ২২০০ ডলারে এসে পৌছেছে। আরো বেশি দেশ স্থিতিশীলতা আর উন্নয়নের পথে ঘুরে দাড়াচ্ছে। গত ৫ বছরে দ্রুত অগ্রসরমান ১০ টি অর্থনীতির ৭ টি ই ছিল আফ্রিকা থেকে। 



স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় আফ্রিকা কিন্তু অনেক বিচক্ষনতার পরিচয় দিয়েছে। এইচ আই ভি মহামারী সত্ত্বেও ১৯৬০  থেকে এখন পর্যন্ত আফ্রিকার মহিলাদের অনুমিত আয়ুষ্কাল ৪১ বছর থেকে বেড়ে ৫৭ বছর হয়েছে।এইচ আই ভি মহামারী না থাকলে এটা ৬১ হত। ১৯৭০ এর পর স্কুলগামী শিশুর সংখ্যা ৪০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭৫ শতাংশ হয়েছে। ক্ষুদার্ত  মানুষের সংখ্যা কমছে,  বাড়ছে  পুষ্টিকর খাবার গ্রহনে সমর্থ মানুষের সংখ্যা। খাদ্যগ্রহণ , স্কুল গমন , গড় আয়ুষ্কাল বৃদ্ধিকে যদি উন্নয়নের মানদন্ড হিসেবে দেখা হয়  তাহলে আফ্রিকা এগিয়ে চলছে কোনো সন্দেহ নেই। এই উন্নতিই  শেষ কথা নয়।  এটা সবে শুরু মাত্র।

কমুনিটি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী দেশের সংখ্যা আফ্রিকা তে ক্রমবর্ধমান।  এটা  অনেক সাশ্রয়ী ও বটে 

অবশ্য এটা ও ঠিক একটা অঞ্চলের গড় আয় দেখে দেশগুলোর আয়ের তারতম্য  বোঝা দুষ্কর। ইথিওপিয়ার মাথাপিছু আয় যেখানে ৮০০ ডলার botswana র সেখানে ১২০০০ ডলার। একটা দেশের ভিতরেও এরকম তারতম্ম্য দেখা যাবে। নাইরোবি ভ জাকজমকপূর্ণ শহর আর কেন্য়ার দুর্গম গ্রামের জীবনযাত্রার মান একরকম নয়। কিন্তু কেউ যদি আপনাকে একটা আস্ত মহাদেশকে দরিদ্র আর রোগজীর্ণ বলে তাহলে বুঝে নিতে হবে ভদ্রলোকের সমস্যা আছে। 


শেষকথা : দরিদ্র দেশ গুলো দরিদ্র থাকতে বাধ্য হয়ে  নেই। তথাকথিত উন্নয়নশীল দেশগুলোর অনেকেই এখন  উন্নত। তার চে বেশি সংখ্যক দেশ এখন সেই পর্যায়ের দিকে চলছে। আর যেসব দেশ উন্নতির রাস্তা খুঁজে পায় নি তাদের জন্য অনেক অনেক উদাহরণ তৈরী হয়েই আছে।

আমি এতটাই আশাবাদী যে আমি একটা ভবিষ্যদ্বানী করতে চাই - ২০৩৫ সালের মধ্যে পৃথিবীতে কোনো দরিদ্র দেশ ই আর  থাকবে না। ( আমি বলছি  আমাদের এখনকার দারিদ্র্যর ধারণার প্রেক্ষিতে ) . যাদের আমরা এখন দরিদ্র বলছি তারা সবাই থাকবে নিম্ন মাঝারি বা ধনী দেশের তালিকায়। দেশগুলো তাদের বিচক্ষনতম প্রতিবেশীর উদাহরণ থেকে শিখবে এবং তাদের নিজস্ব উদ্ভাবনী ক্ষমতা যেমন নতুন ভাকসিন , উন্নত বীজ, এবং ডিজিটাল প্রযুক্তি  কাজে লাগাবে। তাদের শিক্ষিত শ্রমিক আকর্ষণ করবে নতুন উদ্যোগ আর বিনিয়োগ ।

কিছু দেশ পিছনে পরে থাকবে যুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা (নর্থ কোরিয়ায়  যেমন পরিবর্তনকে বন্দী করে রাখা হয়েছে) আর ভৌগলিক কারণে (মধ্য আফ্রিকার দেশ গুলোর মতো ) . বৈষম্য তখন থেকে যাবে কোথাও কোথাও ।  সব অঞ্চলেই কিছু  গরিব লোক থেকেই যাবে। কিন্তু এই গরিব মানুষেরাও বাস করবে এমন সব দেশে যারা নিজেরা মোটামুটি স্বনির্ভর।

এশিয়া , দক্ষিন আমেরিকা , মধ্য আমেরিকা (হাইতি হয়ত বাদ পড়বে ) আর উপকূলীয় আফ্রিকার প্রায় সব দেশই  এখনকার মধ্যম আয়ের দেশের সমপর্যায়ে চলে আসবে। শতকরা ৭০ ভাগ দেশের মাথাপিছু আয় হবে আজকের চীন এর চে বেশি। ৯০ ভাগ দেশের জন্যে এই আয় হবে আজকের ভারতের আয়ের চে বেশি।

এটা অবশ্যই একটা উল্লেখযোগ্য অর্জন। আমার  জন্মের সময় পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ ছিল দরিদ্র।আগামী দুই দশকের মধ্যেই হতদরিদ্র দেশগুলো তাদের গন্ডি কেটে বেরিয়ে আসবে। শত কোটি মানুষ মুক্তি পাবে চরম দারিদ্রের হাত থেকে। আমার জিবদ্দশায় এমনটা ঘটে যাবে ভাবতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত।

কেউ কেউ হয়ত  বলবেন এই দেশগুলোকে মধ্যবিত্ত দেশে রুপান্তরিত হতে সাহায্য করলেই তো আর পৃথিবীর সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে না। বরং কিছু সমস্যা  হয়ত বা তীব্রতর হবে। এটা ঠিক যে এসব উন্নয়নের জন্য আমাদের সুলভ ও বিশুদ্ধ জ্বালানী প্রয়োজন হবে যাতে আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য অটুট থাকে।প্রাচুর্যের পার্শপ্রতিক্রিয়া হিসাবে আমাদের জন্য ডায়াবেটিস নিয়ে পড়তে হতে পারে।কিন্তু এর পরও যেহেতু শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়বে তারা নতুন নতুন সমস্যা সমাধানে অবদান রাখবে।যাই হোক, উন্নয়ন কৌশল (#সম্ভবত জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রকল্পের কথা বলা হচ্ছে ) বাস্তবায়নের দিকে  যতই আগাবে ততই আসলে উন্নততর মানবজীবনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকব আমরা।


মিথ 2
বৈদেশিক সাহায্য একটা বিশাল অপচয়
FOREIGN AID IS A BIG WASTE

আপনি হয়ত পত্রিকায়  এরকম অনেক লেখা পড়ে  থাকবেন যেখানে অল্প কিছু উদাহরণের উপর ভিত্তি করে মোটাদাগে মন্তব্য করা হয়।এসবে  আপনাকে গুটি কয় ঘটনা দেখিয়ে বোঝানো হবে যে বৈদেশিক সাহায্য আসলে একটা বিশাল অপচয়।আপনাকে যদি এরকম ঘটনা বারবার শোনানো হয় আপনি সহজেই  ভেবে বসবেন আসলে বৈদেশিক সাহায্যে কোনো কাজ হয় না। এমনকি গত বছর একটা ব্রিটিশ পত্রিকা রিপোর্ট করেছিল ব্রিটিশ ভোটের দের অর্ধেকই বাইরের দেশে সাহায্য পাঠাবার বিপক্ষে। - এই ধরনের লেখাগুলো আসলে আপনাকে সাহায্য গ্রহীতা দেশগুলো সম্পর্কে ভ্রান্তিকর চিত্র পরিবেশন করে। ১৪ বছর আগে মেলিন্ডা আর আমি যখন আমাদের ফাউন্ডেশন এর কাজ শ্রুকরি তখন থেকেই আমাদের সুযোগ হযেছিল  সরকারী এবং বেসরকারী অনুদানে পরিচালিত কর্মসূচিগুলোর ফলাফল পর্যবেক্ষণ করার। সময়ের সাথে সাথে আমরা যা দেখেছি তা হলো এই কর্মসূচিগুলোর কারণে মানুষ এর স্বাস্থ্য , আয়ু , আর্থিক সামর্থ্যের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে।

বৈদেশিক সাহায্য কোনো কাজে আসে না এই মিথটা বেশ ভয়ানক। কারণ এটা রাজনৈতিক নেতাদের সাহায্য কমানোর অজুহাত তৈরী করে দেয়- যার ফলশ্রুতিতে আরো কম জীবন বাচানো সম্ভব হবে আর স্বনির্ভরতা অর্জনে সময় আরো বেশি লেগে যাবে।

এখানে আমি আপনি শুনেছেন এরকম কিছু সমালোচনার জবাব দিতে চাই। আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে আসলে কোন কর্মসূচীই ত্রুটির উর্ধে নয়, এবং  সংশোধনের ক্ষেত্র সবসময়ই থেকেই যায়। বিদেশী সাহায্য আসলে দারিদ্র বিমোচনের একটা উপকরন মাত্র, উন্নত দেশগুলোকেও নিজেদের নীতি পরিবর্তন করা প্রয়োজন যেমন - কৃষিতে ভর্তুকি হ্রাস, বাজার উন্মুক্তকরন আর দরিদ্র দেশগুলোর জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্য ও মানবসম্পদ উনন্য়নের জন্য খরচ করা।



আরো উদারভাবে বলতে গেলে আর্থিক সহায়তা একটা চমত্কার উদ্যোগ , এবং আমাদের উচিত এধরনের সহায়তার পরিধি বাড়ানো। এটা  দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্র প্রস্তুত করে জীবন    বাচাতে এবং এর মান বাড়াতে খুবই কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এটা খুবই হতাশাজনক যে অনেকে মনে করেন আমাদের ফাউন্ডেশন শুধু ফলাফলের জন্য উদগ্রীব; অনেকে আবার সরকারের আমাদের যৌথ কর্মসূচীগুলো সন্দেহের চোখে দেখেন । ফাইন্ডেশন এইসব কর্মসূচী কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য এবং এর অগ্রগতি নিয়মিত দেখভাল করার জন্য অনেক কাজ করে থাকে।
বৈদেশিক আর্থিক সহায়তা নিকি্উসি আজিজার মত শরনার্থীদের সুস্থ থাকতে সাহায্য করে(কিজিবা ক্যাম্প রুয়ান্ডা)
অনেকের ধারনা অনুদান ধনী দেশগুলোর বাজেটের একটা বিরাট অংশ, অর্থাত অনুদান কমিয়ে অনেক অর্থ বাচানো সম্ভব। জরীপকারীরা আমেরিকানদের জিজ্ঞেস করেছিলেন অনুদানেরর পেছনে আমেরিকার বাজেট কত শতাংশ বলে তাদের ধারনা? " সকলের উত্তরের গড় করলে দাড়ায় ২৫ শতাংশ"।  .কত শতাংশ পর্যন্ত হওয়া উচিত মনে করেন? এই প্রশ্নের উত্তরে মানুষের যে সাধারন উত্তর ছিল তা হল ১০ ভাগ। আমা র ধারনা যুক্তরাজ্য বা জার্মানীতে বা অন্য কোথায়ও এই জরীপ চালানো হলে আপনি একইরকম ফলাফল পাবেন।

আসুন আপনাকে আসল সংখ্যাটা বলি এখন । পৃথবীর সবচে উদার ধনী রাষ্ট্র নরওয়ের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা ৩% এর কম। আর আমেরিকার ক্ষেত্রে তা ১% এরও কম। যুক্তরাষ্ট্রের বাজেটের ১% এর অর্থ হল ৩০ বিলিয়ন ডলারের মত। এর থেকে ১১ বিলিয়ন ডলার খরচ হয় স্বাস্থ্যক্ষেত্রে: প্রতিষেধক, মশারি , পরিবার পরিকল্পনা, এইচ আই ভি চিকিতসা এবং অন্যান্য। বাকী ১৯ বিলিয়ন ডলার খরচ হয় স্কুলঘর , রাস্তা ও সেচ প্রকল্পে।

আমি বলতে চাই না যে ১১ বিলিয়ন ডলার পরিমানে অনেক কম। কিন্তু আমি যদি বিষয়টা এভাবে উপস্থাপন করি - ১১ বিলয়ন ডলার মানে  আমেরিকানদের জন্য মাথাপিছু ৩০ ডলার । একজন আমেরিকানের ট্যাক্স ফর্মের একটি ঘরে যদি এরকম একটা প্রশ্ন রাখা হয় আপনার ট্যাক্স এর পরিশোধিত অংশ থেকে আমরা কি ৩০ $ খরচ করতে পারি যা দিয়ে ১২০ জন শিশুকে হাম থেকে রক্ষা করা সম্ভব। আপনি কি উত্তরে হাঁ বলবেন নাকি না বলবেন?

পূর্বাপর খরচ্গুলোর দিকে আপনি একটু চোখ বুলালে বুঝতে আরো সহজ হবে। মোটামুটি একটা খসড়া হিসাব পেতে আমি ১৯৮০থেকে এখন পর্যন্ত সাস্থ্য খাতে সহায়তার যোগফল নিলাম।  আর তাকে ভাগ করা হলো এই সময়ে আমরা যতজন শিশুর মৃত্যু রোধ করতে পেরেছি সেই সংখ্যা দিয়ে।প্রাপ্ত সংখ্যাটা ৫০০০ $ এর চেয়েও কম ( এখানে শুধু শিশুমৃত্তু রোধ কেই হিসাব করা হয়েছে শিশুদের সাস্থ্য বিবেচনে নিয়া হয় নি. সেক্ষেত্রে সংখ্যা তা আরো ছোট হত।)  ৫০০০ $ অনেকের কাছেই বেশি খরচ মনে হতে পারে। কিন্তু মনে রাখবেন যুক্তরাষ্ট্র সরকারী প্রতিষ্ঠান একজন আমেরিকান এর জীবনের মূল্য কয়েক মিলিয়ন ডলার হিসেব করে।

মনে রাখবেন একটা সুস্থ্য  শিশু বেছে থাকার চেও বেশি কিছু। এরা স্কুলে  যায় , বড় হয়ে কাজ করে এবং তার দেশের স্বনির্ভরতা অর্জনে অবদান রাখে।  এই জন্যই আর্থিক সহায়তা এত গুরুত্ব।আমি কিছু মার্কিন সহায়তা কর্মসূচির সারাংশ তুলে ধরছি। একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন এই সহয়তা কর্মসূচির ফলাফল কতটা আশাব্যঞ্জক।


যুক্তরাষ্ট্রের সরকার সাস্থ্য খাতে সহায়তার প্রায় ২ গুন পরিমান খরচ করে কৃষি ভর্তুকি তে আর সামরিক বাহিনীর পেছনে খরচ করে এর প্রায় ৬০ গুন। 

সুতরাং এরপর কেউ যদি আপনাকে বলে বাজেট ঘাটতি কমাতে সহায়তা হ্রাস করতে হবে তাহলে আপনি তাকে প্রশ্ন করতে পারেন যে এর বিনিময়ে তিনি কতগুলো মৃত্যুর পেছনে খরচ করতে চান । 

দুর্নীতি 

অনুদান নিয়ে খুব সাধারনভাবে প্রচলিত ধারণা হচ্ছে দুর্নীতির পেছনেই এর সিংহভাগ অপচয় হয়। এটা ঠিক সাস্থ্যক্ষেত্রে অনুদানের অর্থ অপচয় হলে  তাতে প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ে। আমাদেরকে ঠগবাজ উচ্ছেদ করতে হবে যাতে প্রতিটা ডলার থেকে আরো বেশি সুফল আদায় করা যায়। 

আমাদেরকে কিন্তু সমস্যা কতটা গুরুতর সেটাও মনে রাখতে হবে। ধরুন কেউ অনুদানের অর্থ থেকে ভুয়া খরচ দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিল। অনুদানের অর্থ থেকে এটা ছোট মাত্রার অপচয় বটে। আমাদের এই সব অপচয় হ্রাস করার চেষ্টা করতে হবে সত্যি যদিও আমরা জানি আর সব সরকারী বা বেসরকারী কর্মসূচির মতো অনুদান কর্মসুচিতেও  এধরনের অপচয় কখনোই  পুরোপুরি দূর করা সম্ভব নয়। ধরুন এইধরনের ছোটখাটো অপচয় একটা মানুষের জীবন বাচাতে যে খরচ হয় তার ২% . আমাদের চেষ্টা থাকবে আমরা যেন এই অপচয় কমাতে পারি। তাই বলে আমাদের কি জনজী বনমুখী  এইসব কর্মসূচি বর্জন করা উচিত হবে? 

The Global Fund to Fight AIDS, Tuberculosis and Malaria.   পরিচালিত মশারি প্রকল্পে দুর্নীতির  কথা আপনারা হয়ত শুনে  থাকবেন। কম্বোডিয়ার কর্মকর্তারা কনট্রাকটরদের  কাছ থেকে ছয় অঙ্কের ঘুষ নেয়ার সময় ধরা পরেছিলেন। পত্রিকার অনুসন্ধানী সম্পাদকরা হেডলাইন করা শুরু করেছিলেন "বিদেশী অনুদান কিভাবে অপচয় হয় " .কোনো একটা লেখায় যাদের প্রদত্ত অর্থ অপচয় হচ্ছিল তাদের সাথে আমার নামও উঠে এসেছিল। 

প্রেস যখন এধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর  জবাবদিহির দায়িত্ব নেয় আমি একে সাদরে গ্রহণ করি। কিন্তু এই নির্দিষ্ট ঘটনায় প্রেস মূল ষড়যন্ত্র উদঘাটন করতে পারেনি যেটা  পরে  Global Fund এর অভ্যন্তরীণ অডিট এ ধরা পড়েছিল। Global Fund সমস্যা সমাধানে সঠিক পদক্ষেপটাই নিয়েছিল। এটা খুবই অবিবেচনাপ্রসূত হত যদি তারা দুর্নীতি সমূলে ওই অল্প কিছু টাকার জন্য দুর্নীতিবাজদের পিছু ধাওয়া করে শাস্তি  দেবার জন্য উঠে পড়ে লাগত।

কার্যক্ষেত্রে দিমুখী নীতি দেখা যায় অনেক । আমিপ্রায়ই  শুনি লোকজন সরকারকে উপদেশ দায় অনুদান কর্মসূচি বন্ধ করে দিতে যখন তারা জানতে পারে এসব কর্মসূচিতে এভাবে অর্থ অপচয় হচ্ছে।  আবার এদিকে ইলিনয়  এর বিগত ৭ জন গভর্নর  এর মধ্যে ৪ জন ই দুর্নীতির কারণে জেলে গেছেন জেনেও কেউ কিন্তু স্কুল , রাস্তা ঘাট , হাইওয়ে র নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেবার কথা তোলেননি বলেই আমি জানি। 

আমি আর মেলিন্ডা Global Fund এর কর্মসূচি তে সাহায্য করার কথা ভাবতাম না যদি আমরা প্রমান পেতাম যে এখানে খুব বড় কোনো দূর্নীতি  হচ্ছে। কম্বোডিয়ায়  ২০০৩ এ Global Fund কর্মসূচি চালু হবার পর থেকে ম্যালেরিয়ায়  মৃত্যুর সঙখ্যা ৮০% কমে গেছে। অনুদানের টাকায়  স্বৈরাচারী শাসকেরা প্রাসাদ তৈরী করছেন এধরনের গল্প আপনারা শুনেছেন সেই সময় যখন শীতল যুদ্ধ চলছে , যখন অনুদান দেয়াই হত নতুন মিত্র তৈরির জন্য। জনজীবনের  উন্নয়নের কোনো প্রচেষ্টার জন্য সেই অর্থ খরচ হত না। সেই সময় থেকে এখন যে কোনো ক্ষেত্রেই অবস্থা অনেক ভালো হয়েছে। নির্দিষ্টভাবে বলতে সাস্থ্য ও কৃষিক্ষেত্রে আমাদের প্রতিটা ডলার যে অবদান রেখেছে তার প্রমান পাওয়া যাচ্ছে। 
২০০ সাল থেকে বৈশ্বিক প্রচেষ্টায় ৩৩ লাখ জীবন বাচানো গেছে। ছবিটি কম্বোডিয়া নোম দাম্বাং গ্রাম থেকে নেয়া। 

সময়ের তালে তালে প্রযুক্তি আমাদেরকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই এ আরো বেশি সাহায্য করতে থাকবে। ইন্তের্নেতের সুবাদে মানুষ এখন তাদের সরকারে সামর্থ্য সম্পর্কে অবগত - তারা জানে এলাকার সাস্থ্য ক্লিনিকের জন্য অর্থ বরাদ্দ্য কত - তাই জবাবদিহিতার সুযোগ এখন আরো বেশি। জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধের সাথে সাথে কমে দুর্নীতি আর অর্থ যথাযথ ব্যাবহার নিশ্চিত হয়। 

অনুদান নির্ভরতা 

সমালোচকদের অনেকের ধারণা অনুদান অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রতিবন্ধক , তাদের যুক্তি হচ্ছে  এর ফলে  দেশ গুলো অন্য দেশের সাহায্যের উপর বেশি নির্ভরশীল  হয়ে  উঠে । 

এই যুক্তিতে বেশ কিছু ভুল রয়েছে। প্রথমত এটা সব ধরনের অনুদানকে এক করে দেখেছে।  ভ্যাকসিন বা ফসলের বীজ নিয়ে গবেষনার কাজে ব্যয় হবার কথা এমন সরাসরি সরকারি  অনুদানকে তারা আলাদাভাবে দেখে না। ১৯৬০ এর দশকে কৃষিজাত পণ্যের ফলন বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্র দ আমেরিকা আর এশিয়া তে অনুদান দিয়েছিল তা ওদেরকে আমাদের উপর নির্ভরতা কমাতে সাহায্য করেছে, বাড়াতে নয়। আফ্রিকার সবুজ বিপ্লবের পেছনে আমরা যে অর্থ খরচ করছি তা সাহায্য করছে নতুন ও উন্নত খাদ্য উত্পাদনে , সেই সাথে আমাদের উপর নির্ভরতা কমাতে সাহায্য করছে। পৃথিবীর বাসিন্দাদের জন্য অনুদান তাই অর্থের একটা গুরুত্বপূর্ণ সংস্থান। আর তাই আমাদের ফাউন্ডেশন পরে এক তৃতিয়াংশ অনুদান প্রদান  করে নতুন যন্ত্রপাতি তৈরী তে।  ********************

দ্বিতীয়ত , অনুদান পরনির্ভরতা জন্ম দেয় এই  ধারণাটা  অনুদান নির্ভর যেসব দেশ তাদের বেশির ভাগ সমস্যা থেকে মুক্তি পেয়ে এখন অল্প কিছু গভীর সমস্যা সমাধানে কাজ করছে তাদের গ্রাহ্য  করে নি। আমি একটা লিস্ট দিছি এমন কয়েকটা দেশের যারা অনুদান কাজে লাগিয়ে এখন এমন একটা পর্যায়ে চলে গেছে যে এদের এখন অনুদানের আর প্রয়োজন এ পড়ে  না - বতসোয়ানা , মরক্কো , ব্রাজিল, মেক্সিকো ,চিলি , কস্তা রিকা পেরু থাইল্যান্ড , মরিশাস , সিন্গাপুর  এবং মালয়শিয়া। কোরিয়ান যুদ্ধের পর  দ কোরিয়া প্রচুর অনুদান পেয়েছে এবং এখন  তারা দাতা দেশের কাতারে চলে এসেছে। চীন এখন অনেক উন্নয়ন শীল দেশেই সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। ভারত জিডিপি র ০.০৯% সাহায্য হিসাবে পেয়ে থাকে যা ১৯৯১ সালে ছিল ১% . [টীকা: ১৯৮৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত অনুদান নির্ভরতা বাংলাদেশ ৮৫% থেকে ২% এ নিয়ে এসেছে 1988 source 2010 source ]

এমনকি সাব সাহারান আফ্রিকার অর্থনীতিতেও অনুদানের অংশ  ২০ বছর আগের তুলনায় এখন এক তৃতিয়াংশ নেমে এসেছে যে সময়ে ওদের অনুদানের পরিমান প্রায় দ্বিগুন হয়েছে । "ইথিওপিয়ার  মতন দেশগুলো এখন অনুদান নির্ভর" - অন্যান্যদের মত আমরা এবং ইথিওপিনারাও চায়  যে কোনো একদিন এই কথাটার সত্যতা অটুট থাকবে না।  ইথিওপিয়ার আর্থিক সাহায্য কমিয়ে দেয়াটা ভালো হবে - এর পক্ষে কোনো যুক্তি/কারণ আমি দেখিনা।  

সমালোচকদের একটা বক্তব্য সঠিক , অনুদান অর্থনৈতিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত করে এমন কোন প্রমান নেই ।সে কথা কিন্তু অর্থনীতির  অন্য অনেক ক্ষেত্রেই বলা যায়। কোন পদক্ষেপে যে আসলে অর্থনীতি ঘুরে দাড়াবে তা আগে থেকেই কখনও বলা যায় না । আর নিকট স্বল্পমেয়াদের জন্য এরকম কিছু অনুমান করতে পারা আরও বেশি দুরূহ। যাই হোক , আনুদানগুলো সাস্থ্য, কৃষি আর অবকাঠামো উন্নয়নে অবদান রাখে আর এভাবে পরোক্ষভাবে দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক উন্নতিকে ত্বরান্নিত করে। সাস্থ্যক্ষেত্রে অনুদান অনেক জীবন বাচায় এবং শিশুদের ক্ষেত্রে মানসিক ও শারিরীক বৃদ্ধিতে অবদান রাখে যার ফলাফল এক প্রজন্মেই পাওয়া যায়। গবেষনায় জানা যায় এসব শিশুরা সুস্থ পরিনত মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠে  এবং কর্মক্ষেত্রে অধিক উত্পাদনশীলতা প্রদর্শন করে। আপনি যদি এধরনের অনুদানের বিরুদ্ধে বলেন তাহলে আপনি বলতেই পারেন জীবন বাচানো আসলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কোন কাজে আসে না বা জীবন বাচানো কোন কাজেই আসে না ।

অনুদানের জীবন বাচানোর ক্ষমতা এতই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার যে সমালোচকরাও এটা স্বীকার করেন। উইলিয়াম ইস্টারলি তার White man's burden বইতে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বেশকিছু অর্জনের কথা উল্লেখ করেছেন।
১. আফ্রিকার দক্ষিনাঞ্চল শিশুদের প্রানঘাতি হাম থেকে মুক্ত করা গেছে ।
২. আন্তর্জাতিক উদ্যোগে গুটিবসন্ত বিলুপ্ত হয়েছে
৩. যক্ষা দূরীকরন কর্মসূচী চীনে ১৯৯০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে এর প্রকোপ ৪০ ভাগ কমাতে সমর্থ হয়েছে।
৪. পোলিও র বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার ফলে ল্যাটিন আমেরিকা জনস্বাস্থ্যের একটা বড় হুমকি থেকে মুক্ত হয়েছে ।

পৃথিবীতে এখন পোলিও মুক্ত নয় এমন দেশ মাত্র তিনটি আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং নাইজেরিয়া। আন্তর্জাতি সম্পরদায় গত বছর ২০১৮ সালের মধ্যে বিশ্বকে পোলিওমুক্ত করার অঙ্গিকার ঘোষনা করেছেন। কয়েক ডজন দাতা গোষ্ঠী অর্থায়নে উতসুক হয়ে আছেন। আমরা যখন পুরোপুরি পোলিওমুক্ত হব  আমাদের প্রতিবছর ২ বিলিয়ন ডলার বেচে যাবে যা এখন পোলিও রোগের বিরুদ্ধে অভিযানে খরচ হয়।


শেষ কথা :স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে অনুদান আসলে অসাধারণ একটা বিনিয়োগ।  ৩০ বছর আগের চে শিশুমৃত্যুর সংখ্যা কত কমে গেছে, বেড়েছে মানুষের আয়ু আর স্বাস্থ্য , এই ব্যাপারগুলো আমাকে ভবিষ্যত নিয়ে আমাকে আশাবাদী করে। ভবশ্যতের বছরগুলোর সম্ভাবনা নিরুপন করতে  আমাদের ফাউন্ডেশন একদল দক্ষ অর্থনীতিবিদ আর স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সাথে কাজ করেছে। তারা গত মাসে  The Lancet  এ রিপোর্ট দিয়েছেন - সঠিকভাবে বিনিয়োগ করা গেলে ২০৩৫ সালের মধ্যে সারা পৃথিবীর শিশুমৃত্যুর হার আমেরিকার বা যুক্তরাজ্যের  ১৯৮০ সালের হারের সমান পর্যায়ে নেমে আসবে। নিচের চার্ট থেকে এই গতিমান প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।




কাল পরিক্রমার দিক থেকে এই অর্জনগুলোকে বিবেচনা করে দেখা যাক - ১৯৬০ সালে জন্ম নেয়া একটা শিশুর পঞ্চম জন্মদিনের আগেই মৃত্যু হবার সম্ভাব্যতা ছিল ১৮ শতাংশ। আজকে যে শিশুটি জন্ম গ্রহণ করছে তার ক্ষেত্রে এই সম্ভাব্যতা ৫ শতাংশের কম। ২০৩৫ সালে এই সংখ্যাটা হবে ১.৬ শতাংশের কম। ৭৫ বছরের ব্যবধানে আর কোনো মানব্কল্যান প্রকল্পের এত অভূতপূর্ব সাফল্য আমি মনে করতে পারছি না। 

সেই লক্ষ্যে গবেষক থেকে শুরু  করে স্বাস্থ্যকর্মী , দাতা এবং গ্রহীতা সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। জাতিসঙ্ঘের  সহস্রাব্দ উন্নয়ন কর্মসূচির পরবর্তী ধাপে এই লক্ষ্য সংযোজিত হলে সবার এক হয়ে  কাজ করা  অনেক সহজ হবে। 

ভবিষ্যতে অনেক নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের দেশ নিজেদের উনয়নের ব্যবস্থা নিজেরাই করার মত উন্নতি করবে। অন্যদের হয়ত দাতা দেশগুলোর নিরবচ্ছিন্ন সহায়তার প্রয়োজন হবে থাকবে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে গবেষণার মত বিষয় গুলোতে। সরকারগুলোকেও সঠিক নীতিমালা প্রনয়ন করতে হবে। যেমন মধ্যম আয়ের দেশগুলোর সরকারকে তামাকের উপর কর বসাতে হবে এবং জীবাশ্ম জ্বালানির উপর ভর্তুকি কমাতে হবে যেন স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে অর্থায়ন বাড়ানো যায়।  

আমি  মনে করি এখন আমরা অনুদান কাজে লাগে কিনা সেই বিতর্ক থেকে সরে এসে আমাদের সময়কে কাজে লাগাতে পারি এটা কিভাবে আরো ভালোভাবে কাজে লাগান যায় সেই আলোচনায়।গবেষনার উছতর স্তর থেকে নিচে নেমে   যতই সেই গবেষনার ফলাফলকে সাধারণের মঙ্গলের জন্য ব্যবহার করতে যাব ততই এর প্রয়োজনীয়তা বেশি উপলব্ধি করতে পারব। অনুদান গ্রহীতা দেশগুলো কি কোথায় কোথায় ক্লিনিক স্থাপন করতে হবে, কথে প্রশিক্ষণ এর ব্যবস্থা হবে এসব  ঠিক করেছে? পশ্চিমা প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষনে প্রশিক্ষনার্থীরা নিজেদের কাজ নিজেরাই চালিয়ে নিতে পারার সক্ষমতা অর্জন করছে কিনা ? সফলরা কি তাদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করছে যেন অন্যরা তাদের অনুসরন করতে পারে? এইসব ক্ষেত্রে অনেক কিছু এখন জানার/শেখার আছে। 

অনেকদিন ধরেই আমি বিশ্বাস করেছি স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বৈষম্য পৃথিবীর সবচে নিকৃষ্ট । এটা  আমার মানতে কষ্ট হয়  যে প্রতিবচ্চর কয়েক মিলিয়ন শিশু এমন সব কারণে মারা যে যেসব কারণ আমরা চাইলেই প্রতিরোধ করতে পারতাম।  আমি মনে করিনা একটা শিশু কোন জরায়ু তে জন্ম নিচ্ছে, (ওয়ারেন বাফেট এর ভাসায় ওভারিয়ান লটারী) তার উপর তার ভাগ্যনিয়ন্ত্রিত হোক। আমরা যদি আমাদের লক্ষ্যে পৌছাতে পারি তাহলে এই স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে এই ওভারিয়ান লটারি আমরা চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দিতে সক্ষম হব।