২০১৪ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল হয়ে গেল। জার্মানি শেষ পর্যন্ত দুর্দান্ত খেলে শিরোপা জিতে নিল । নিজে সাপোর্টার বলেই একটু উচ্ছসিত আমি নিজেও । এলাকার সমবয়সী সবাইকে রোজার দিনে কিছু খাওয়ানোর আশ্বাস না দিয়েই বাসায় ডেকে এনেছিলাম। সাদাত-তিয়াসা পরিবার , নাবিলা আর এরফান। সামি আর তাপসের সঙ্গে এমনিতেই সবসময় খেলা দেখি , ওরা তো আছেই ।
আজিম ভাই নাবিলার হাসব্যান্ড। বাকিরা সবাই মোটা মুটি ব্রাজিল ভক্ত হলেও তিনি নিজে মূলত আর্জেন্টিনা সাপোর্টার। নিজের দলের খেলা কত গুলো শত্রু সমর্থকের মাঝে বসে দেখা সমীচীন মনে না হওয়াতেই হয়ত, উনি এই ভিড়ে শামিল হয়ে খেলা দেখতে এলেন না। বউ কে পাঠিয়ে দিলেন। সময়মত সবাই চলেও আসলো। বিশ্বকাপ শুরুর আগেই ঘোষণা দিয়েছিলাম জার্মানির প্রতিটা জয় এর বিপরীতে আমি একবার করে বিরিয়ানি খাওয়াব । রোজার মাসের মধ্যে পরে যাওয়ায় ফ্রান্স আর ব্রাজিল এর বিপক্ষে জয়ের বিরিয়ানি রান্না টা বাকির খাতায় চলে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম ঐদিন খেলা শেষে বিরিয়ানি রান্না হবে । সবাইকে নিয়ে বিরিয়ানি খেয়েই না হয় ইফতার করলাম। অবশ্য জার্মানি যেভাবে ম্যাচ জিতলো। টেনশন এ ধরে গেল আমার মাথা ব্যথা । বিরিয়ানি রান্নার ইচ্ছার কথা কাউকে জানাইওনি তাই। সবাইকে বিদায় দিলাম খেলার পরই।
জার্মানি সাপোর্টার হয়েছি ঠিক কবে থেকে স্পষ্ট মনে পড়ে না। ১৯৯৮/৯৯ এর দিকে হবে হয়ত । আমার স্মৃতি শক্তির শেষ সীমায় একটু যদিও বা উকি মারে তো ১৯৯৪ এর বিশ্বকাপের খেলাগুলা হত বেশ রাতে। গভীর রাতে ভাইরা একসাথে বসে খেলা দেখা চলত । খেলা শেষ হতে হতে ভোর হয়ে যেত। তারপর স্কুল।আমার ভাই-বোন্ আর নিকটতম প্রতিবেশীরা আর্জেন্টিনার ম্যারাডোনার বিশাল ভক্ত । ওদের মনে ১৯৯০ এর জার্মানি র কাছে আর্জেন্টিনার হার এর দগদগে ঘা তখনো জ্যান্ত। জার্মানরা যার বিপক্ষেই খেলুক না কেন সবাই ওদের বিপক্ষে। সেই বিশ্বকাপে বুলগেরিয়ার কাছে হেরে জার্মানি বিদায় নিল। জার্মানি কে সবাই এতটা অপছন্দ করত যে ওদের জন্য মনের অজান্তেই মায়া জন্মে যাচ্ছিল আমার । যদিও ওরা খেলত তখন খুব নেগেটিভ। আর তাই জার্মানদের সমালোচনাও হত খুব বেশি।
১৯৯৮ এ আপসেট এর জন্ম দিয়ে ক্রোয়েশিয়ার কাছে হেরে বিদায় নিল জার্মানি।
২০০২ এ রানার-আপ হলো ওরা তারপর ও খোচার কমতি নেই। কারণ ফাইনালে উঠতে দ. কোরিয়া , U.S .A র মত সবচে দুর্বল দলগুলোর সাথে খেলে এসেছে জার্মানি। এতদিনে আমি জার্মান দের পাড় সমর্থক। কারণ কিন্তু পুরোপুরি অ-ফুটবলীয় । আর্জেন্টিনা সমর্থকরাই যে শুধু নয় ,পুরো পৃথিবী যে ওদের অনেক ঘৃনা করে একটু সেটা টের পেলাম commandos গেম খেলে। যেই গেমের মূল মিশনই হচ্ছে বিভিন্ন ভাবে জার্মান সৈন্য মারা। তত দিনে আইনস্টাইন , ম্যাক্স প্লান্ক দের নাম জানি। জানি এই জাতি যুগে যুগে এমন সব মনিষীদের জন্ম দিয়েছে যারা পৃথিবীর সভ্যতার গতি প্রকৃতি বদলে দিয়েছে। জার্মানদের প্রতি সবার ঘৃনার কারণেই হয়ত জাতি হিসেবে ওদের প্রতি আমার একধরনের শ্রদ্ধা জেগে উঠেছিল। ১৯৪৫ এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধংসস্তুপের উপর দাড়িয়ে থেকে প্রথম ফুটবল বিশ্বকাপেই পশ্চিম জার্মানি শিরোপা যেতে। এরকম একটা কাম ব্যাক এর ইতিহাস আমাকে অনুপ্রানিত করে ওদের সমর্থন দিতে। তাই সম্পূর্ণ অফুটবলীয় কারনে হলেও আমি ততদিনে বিশ্বকাপ ফুটবলে ঘোর জার্মান সমর্থক। কিন্তু ওরা যতটা না খারাপ খেলত তার চে বেশি খেলত বোরিং আর নেগেটিভ। আসলে ওদের তখনকার দলের কম্বিনেশনে ওই ধরনটাই ছিল পারফেক্ট।জার্মানি সমর্থক হিসেবে ম্যাচ জিতেও টিটকারী শোনা ছাড়া আর কোন লাভ ই হয় নাই ।
২০০৬ বিশ্বকাপ এ আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয় এর হল এ থাকি । এর মধ্যে ২০০৩/৪ এর দিকে সালে জার্মান ফুটবল টীম কে ঢেলে সাজানো হয়েছে। দলে নেয়া হয়েছে বেশ কিছু নতুন খেলোয়াড় । কোচ হয়ে এসেছেন ক্লিন্সমান। তিনি জার্মান দলের খেলার ধরনটাই বদলে দিলেন।ওদের খেলা চরম রক্ষনাত্মক থেকে হে উঠলো তুমুল আক্রমনাত্মক।কোস্টারিকার মত দলের সাথে প্রথম ম্যাচএ ২ টা গোল খেয়ে বসলো; আর করলো ৪ তা। সেই খেলে ফ্রিনস এর গোল টা অনেক দিন পর্যন্ত ওই বিশ্বকাপের সেরা গোল হয়ে ছিল। এক দম নতুন দল হিসাবে প্রত্যাশার অতিরক্ত খেলে ওরা তৃতীয় স্থান পেল।হতাশ হলেও এই প্রথম অনেক গলাবাজি করে বিশ্বকাপ দেখলাম।
২০১০ এ প্রথম ম্যাচ এ ৪-০ তে অস্ট্রেলিয়া কে হারিয়ে শুরু করলো জার্মানি। ওদের খেলা দেখে এইবার আমি সেইরকম আশাবাদী কাপ ওরাই নিবে। স্পেন এর তখন দোর্দণ্ড প্রতাপ। সুইজার ল্যান্ড এর কাছে ১-০ স্পেন হেরে যাওয়ায় আমার আসার পারদ চরমে - স্পেন কে হারানো অসম্ভব নয়। গায়ে পড়ে অন্য সমর্থক দের সাথে ঝগড়া করে আসি। সবচে মজার ব্যাপার জার্মানি হারবে আর আমাকে সেই সুযোগে আচ্ছামত পান দেয়া যাবে ,এই আশায় বন্ধুরা আমার সঙ্গেই খেলা দেখতে বসত। সার্বিয়ার কাছে হারার পর পুরা একদিন ফোন বন্ধ রাখতে হয়েছিল আমাকে।কিন্তু ফলাফল বেশিরভাগ সময় উল্টাটাই হত। যাই হোক, আবারো বাদ পড়ল জার্মানি। এবং এবারও সেমিফাইনালে । এনিওয়ে দেয়ার ইস অলয়েইস এ নেক্সট টাইম।
২০০৬ আর ২০১০ এ জার্মান দের প্রতিটা গোল এর জন্য বন্ধুদের coke খাইয়েছিলাম। প্রত্যেকটা বোতলের গায়ে লিখে রাখা হয়েছিল কোন বোতলটা কোন গোল উপলক্ষে। সেগুলো সংগ্রহে ছিল অনেক দিন। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত শহীদ স্মৃতি হল এ বন্ধু শরীফ এর রুম এ আশ্রয় হয়েছিল ওদের। তারপর কি হয়েছে খোজ নেয়া হয় নাই।
২০১৪ এলো এবার ও খেলা দেখে মনে হচ্ছে জার্মানি কাপ নিতেই পারে। বিরিয়ানির ঘোষণা দিয়েছিলাম ঠিকই । কিন্তু মনে সাহস পাই না । এই প্রথম আমি দেশের বাইরে বসে বিশ্ব কাপ দেখছি। জার্মানি কে এতদিন অকারণেই সাপোর্ট করতাম। এখন একটা শক্ত কারণ ও তৈরী হয়েছে - আমি একটা জার্মান কোম্পানি তে চাকরি করি । 'নুন খাই যার গুন গাই তার' টাইপ লজিক।
আমার বন্ধু ভানু , জাতিতে ভারতীয়। ফাইনালএর দিন এসে বলল সে জার্মান ভক্ত "আমি জার্মানি সাপোর্টের ঈঈঈঈঈঈঈঈই " .. ।আমি মুখ ফুটে বলতেই পারলাম না যে, আমিও তাই ।মুখে আসলো না। আমার ইগো অত্যন্ত প্রবল।একটা ভারতীয়র সামনে আমি ফুটবলে ভিনদেশকে সাপোর্ট করি এইটা বলতে একটু বাধলো।
নিজের দেশে সারাদিন টিভিতে মুক্তিযুদ্ধের অনুষ্ঠান কিংবা মুজিব-জিয়ার ঠুনকো আদর্শ আমার যেই স্বজাত্যবোধ জাগাতে পারে নি। ৩ বছরের প্রবাস জীবন তাকে বেশ যত্নেই লালন পালন করে গড়ে তুলেছে । আমাদের বন্যা নিয়ে যখন এদেশের কেউ কিছু বলে। তখন আমিও বলি আমাদের 'ফ্লাড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম' থেকে চাইলে তোমরাও কিছু শিখতে পারো। ২ দিন বন্যা হলে তোমরা টিভিতে সারাদিন তাই নিয়ে নিউজ কর। আমার দেশে মানুষ মাসের পর মাস বন্যার সাথে লড়াই করে টিকে থাকে। আমাদের বিজ্ঞানীরা এমন ধান আবিষ্কার করেছেন যা বন্যার পানির লেভেলের উপরে মাথা তুলে দাড়িয়ে থাকে। আর তাই আমাদের এখন বন্যায় ফসল নষ্ট হয় না আর। বন্যায় ভেসে আসা পলি তে আমাদের দেশের মাটির লেভেল বাড়ছে। আর তাই গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর প্রাকৃতিক সমাধান হিসাবেই বন্যা আমাদের প্রয়োজন। আমরা বন্যা কে নিজেদের কাজে লাগাতে শিখেছি। আমাদের গার্মেন্টস শিল্পের অসন্তোষ নিয়ে যখন বলে আমি তখন ওদের ওয়াল -স্ট্রিট দেখিয়ে দেই।
জানি সবই কৌশলে সভ্যতার মোড়কে পেচিয়ে পরিবেশন করা যুক্তি।
তারপরও আমাদের দেশের মানুষের নানা ক্ষেত্রে অসহায়ত্বর কথা মেনে নিয়ে নিজের দেশকে ছোট করতে পারি না। জার্মানি - ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা র মত দেশের এমন উত্তাল সমর্থন দেয়াটা যে কতটা দীনহীন মানসিকতার তা বুঝতে আমার কেটে গেছে জীবনের অনেক গুলো বছর। মনে মনে এখন জার্মানি সমর্থন করে খেলা দেখতে বসলেও মনের অনেক গভীরে একটা আফসোস উকি দেয়। আমার দেশ বিশ্বকাপ খেলে না। নিদেন পক্ষে অলিম্পিকও না। জাতি হিসাবে আমাদের অর্জন প্রায় শুন্যের কোথায়।
তারপরও আমাদের দেশের মানুষের নানা ক্ষেত্রে অসহায়ত্বর কথা মেনে নিয়ে নিজের দেশকে ছোট করতে পারি না। জার্মানি - ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা র মত দেশের এমন উত্তাল সমর্থন দেয়াটা যে কতটা দীনহীন মানসিকতার তা বুঝতে আমার কেটে গেছে জীবনের অনেক গুলো বছর। মনে মনে এখন জার্মানি সমর্থন করে খেলা দেখতে বসলেও মনের অনেক গভীরে একটা আফসোস উকি দেয়। আমার দেশ বিশ্বকাপ খেলে না। নিদেন পক্ষে অলিম্পিকও না। জাতি হিসাবে আমাদের অর্জন প্রায় শুন্যের কোথায়।
সভ্যতার সেই কবে এই পশ্চিমে এসে খুটি গেড়েছে। তাকে এই পূর্বে নিয়ে আসতে আর কত দিন অপেক্ষা করতে হবে? -সুনীল আক্ষেপ করেছিলেন। সে আক্ষেপের তীব্রতাটা প্রতিনিয়ত বেড়ে উঠছে জার্মানি বা ব্রাজিল প্রতিটা বিশ্বকাপ বিজয়ে ,আমেরিকার মঙ্গলে অভিযানে , পদার্থ রসায়নে অন্যদের নোবেল পুরস্কার বিজয়ে । এরকম প্রতিদিনের জন্যে আর কতদিন অপেক্ষা করবে বাংলাদেশ?
0 comments:
Post a Comment