Thursday, May 21, 2015

প্রবাসী শ্রমিকের দপ্তর থেকে ৬

Posted by with No comments
আমার জন্ম রোহিঙ্গা শিবিরে হতেই পারত। বাংলাদেশে এরকম সোয়া ৪ কোটি মানুষ আছে যাদের ১ দিনের আয় এদেশে একটা গড়পরতা মানুষের ১৫ মিনিটের আয়ের চেয়ে কম।  ঐসব পরিবারের যেকোনো একটায় আমার জন্ম হতেই পারত।  আমি হয়ত সাগরে ভেসে যাওয়া নৌকায় চেপে বসতেই পারতাম বেনিয়াদের আশ্বাসে। কোনো ভাবে উপকূলে পৌছুতে পারতাম হয়ত। জঙ্গলে বাঘের খাদ্য না হয়ে , অথবা দালালের ক্ষুরধার ছলে বিভ্রান্ত হয়ে কবরস্থ হবার আগেই হয়ত পেয়ে যেতাম একটা নির্মান শ্রমিকের কাজ। পেটেভাতে হয়ত বেচে  থাকতে হত না আমাকে। কিছু টাকা পয়সা জমেই যেত বছর শেষে।

পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের স্বপ্নের শেষ সীমাটা এইরকমই।

আমাকে এমন স্বপ্ন দেখতে হয়নি। জন্মের আগেই ওভারিয়ান লটারিটা  জিতে নিয়েছিলাম বলে। আমার বাবা-মায়ের নিজের বলার মত একটা দেশ ছিল, তাদের সেখানে থাকার মত জায়গা ছিল, বিপদে পাশে দাড়ানোর মতন প্রতিবেশী ছিল, আমাকে স্কুলে ভর্তি করানোর ইচ্ছা এবং সামর্থ্য ছিল।  I am born lucky.





Monday, May 18, 2015

রকি পর্বতমালা , আলবার্টা, কানাডা

Posted by with No comments
মে মাসের শেষ সোমবার মেমোরিয়াল ডে তে মার্কিনিরা এযাবত সব যুদ্ধে নিহত সেনা সদস্য দের স্মরণ করে। এইজন্যে সরকারিভাবে ১ দিনের ছুটি থাকে । Weekend এ শনিবার, রবিবার মিলিয়ে ৩ দিন। এইরকম ৩ দিনের ছুটিকে এদেশে সাধারন মানুষ  বলে "Long  weekend"। বুদ্ধিমানেরা শুক্রবার ঐচ্ছিক ছুটি নিয়ে একে   "Longer   weekend"বানিয়ে ফেলে। প্রতিবছর এই কাজটা  আমিও করি। দুই ঈদের নামাজের মতন মেমোরিয়াল ডে আর লেবার ডে  তে বেশ বড়সর দুইটা  রোড ট্রিপ দেওয়া একটা ধর্মীয় আচারের মতন হয়ে দাড়িয়েছে আমার জন্য। গত বছর এই সময়টাতে গিয়েছিলাম প্রশান্ত মহাসাগরের পাড় ঘেষে ছুটে চলা প্যাসিফিক কোস্ট হাইওয়ে ধরে। এখনো পর্যন্ত আমার জন্য "Best road trip  ever" । এবারের প্লান রকি পর্বতমালা। তিনগোয়েন্দার রকি বিচের ধারের রকি নয়। এই পর্বতমালার সবচে সুন্দর অংশ নাকি কানাডায়। আর সেখানেই আমাদের নিয়ে যাবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বন্ধু আফজাল হোসেন রূপক। সিনসিনাটি থেকে আমি আর তাপস; ভাঙ্কুবার থেকে আসছে রুশদী সুপ্তি আর য়ারা।

প্রস্তুতি হিসেবে কানাডার ভিসা নেওয়া হয়েছে ফেব্রুয়ারীতেই। ভিসা প্রসেস আমেরিকার ভিসা প্রসেস এর মতন খুব একটা সহজবোধ্য নয় , একটু যেন বিরক্ত লাগে এত এত ডকুমেন্ট একাধিকবার আপলোড করতে হয় বলে। aplication এক জায়গায় তো aplication fee  আরেক জায়গায়। দুর্বোধ্য আরো অনেক নিয়ম কানুনের বালাই। তার উপর নিজেও করেছি ভুল। ভিসার আবেদন পত্রে নাম ধাম পেশা এইসব ইংরেজির পাশাপাশি মাতৃভাষাতেও লেখা নিয়ম। আমি বেখেয়ালে শুধুই ইংরাজিতে ফর্ম ফিলআপ করে  বাড়তি টেনশনের ব্যবস্থা পাকা করেছি। অবশ্য ৬ মাসের ভিসা চেয়ে বেলাশেষে ৪ বছরের মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা পেয়ে বিরক্তি মুছে গিয়ে দিল খুশ হয়ে গেল।

সিনসিনাটি থেকে রেজাইনা পর্যন্ত দুরত্ব পাড়ি দিচ্ছি ডেল্টা এয়ারলাইন্স এর বিমানে চেপে । মিনিয়াপলিস এ ছোট্ট বিরতি।  এর বিপ্রতীপ ক্রমে পাড়ি দেয়া হবে ফিরতি পথটাও। মাঝখানে ৩ দিনে রেজাইনা থেকে গাড়িতে চেপে ঘুরে আসব "কানাডিয়ান রকিস"এর বিখ্যাত "বান্ফ মেমোরিয়াল পার্ক"।

বিমানসূচি :

Thu, 21MAYDEPARTARRIVE
DELTA 3652*
MAIN CABIN (T)
CINCINNATI
5:20pm
MPLS-ST PAUL
6:18pm
DELTA 4682*
MAIN CABIN (T)
MPLS-ST PAUL
7:45pm
REGINA
8:57pm
 Mon, 25MAYDEPARTARRIVE
DELTA 4490*
MAIN CABIN (V)
REGINA
3:02pm
MPLS-ST PAUL
6:00pm
DELTA 3933*
MAIN CABIN (V)
MPLS-ST PAUL
7:21pm
CINCINNATI
10:19pm

আমাদের প্রথম লে ওভার মিনিয়াপলিস , দের ঘন্টার মত লম্বা উড়াল ভ্রমন। মাঝখানে জানালা দিয়ে একসময় দেখা গেল লেক মিশিগান -
   

বলার মতন কোনো ঘটনা ছাড়াই পৌছে বিমান পৌছে গেল রেজাইনা এয়ারপোর্ট। ইমিগ্রেশন অফিসার কোথায় যাবা , কয়দিন থাকবা , এইসব কিছু প্রশ্ন করে ছেড়ে দিল। আজ পর্যন্ত ৪ টা দেশের ইমিগ্রেশন অফিসার দেখলাম। কানাডার রেজাইনা এয়ারপোর্ট এর ,মতন এত দ্রুত অভিবাসী নিকাশঘর আগে কোথাও দেখি নাই।

এয়ারপোর্ট থেকে বের হলে সবসময় ই যে ব্যাপারটা  ঘটে সেটা হচ্ছে ওয়েদার শক। নতুন দেশের নতুন আবহাওয়া এবং তাপমাত্রা। সিনসিনাটি থেকে যখন রওনা  দেই তখন সেখানে তাপমাত্রা ছিল ৫৭ ° ফা। ধরেই নিয়েছিলাম রেজাইনা  তে ৪০ কি ৪৫ তো হবেই। শক খেলাম পুরাই উল্টা দিক থেকে। রেজাইনার তাপমাত্রা তখন ৭৫ ° ফারেনহাইট।

সকালে সনিকে অফিসে দিয়ে এসে আমরা তিনজনে বের হলাম রেজাইনার পার্লামেন্ট এর পাশে হাটতে। সেখানে বেশ সুন্দর চেরি ফুটেছে।





রেজাইনা থেকে বান্ফ গাড়িতে ৮ ঘন্টার দুরত্ব। পথের জন্য কিছু snacks, বান্ফ এ গিয়ে বার বি কিউ এর জন্য প্রস্তুতি, আর মলে গিয়ে কিছু উপহার সামগ্রী কিনে দুপুর পার করে দেয়া হলো। বাসায় ফিরে রূপকের স্পেশাল খিচুড়ি । 

অতঃপর যাত্রা বান্ফের পথে। সনিকে অফিস থেকে তুলে নিয়ে দীর্ঘ ৮ ঘন্টার ড্রাইভিং। রূপক একাই করলো। ক্যালগেরি শহর পার হতেই একটু একটু করে রকি মাউন্টেন উকি মারতে থাকে। একসময় প্রকান্ড সব পাহাড় পর্বতেরা সার বেধে দাড়িয়ে যায় পথের দুপাশে। আমাদের আপাত গন্তব্য ক্যানমোর শহর। পৌছুতে বেজে যায় রাত দশটা। 

পরদিন সকালে লজের ব্যালকনি থেকে পাহাড়কে পেছনে রেখে তোলা আমাদের এই ছবিটা জায়গা পেতেই পারে এইখানে। 


কফির জন্যে আমেরিকায় যেমন আছে স্টারবাকস কানাডার আছে টিম হর্টনস। সকালের প্রাতরাশ আর কফি চলল এক দফা সেখানে। 



কফির পর সালফার মাউন্টেন। এখানে হাইক  করে উঠা যায় ৫.৫ কিলোমিটার ট্রেইল, এলিভেশন গেইন অবশ্য মাত্র ৬৫৫ মিটার। আমাদের সবার হাইক  করার সামর্থ্য বা পর্যাপ্ত ইচ্ছাশক্তি নেই তাই মাথা প্রতি ৪০ ডলার খরচ করে কেবল কার নেয়া হলো। চূড়ায় অবশ্য সিড়ি  বাধানো পথ আছে। সেখান থেকে চার পাশের উপত্যকার নৈসর্গ উপভোগ করা যায়। 



ঘন্টা খানেক পর আমরা রওনা  দেই লেক লুইস এর পথে। ২০ মিনিট কি  আধা ঘন্টার দুরত্ব হবে সালফার মাউন্টেন থেকে। এখানে মে মাসের শেষ সপ্তাহে এসেও বরফ মাত্র গলতে শুরু করেছে । আর কদিন পরে এলেই কায়াকিঙ  করা যেত অনায়াসে। সমুদ্র সমতল থেকে ১৭৫০ মি (৫৭৪১ ফুট ) উচ্চতায় এখানে পানি জলজ শৈবালের কারণে turquoise নীল্ বর্ণ ধারণ করে আছে।




কাছেই আবার ২০ মিনিটের দুরত্বে আছে মোরেন লেক। সেটা আরেকটু উচুতে ১৮৮৪ মি (৬১৮১ ফুট) এখানে বরফ আরেকটু বেশি। মোরেন লেক এর ভিস্তা পয়েন্ট এ দাড়ালে পাশের ১০ টা চূড়াকে একসাথে দেখতে পাওয়া যায়। সুপ্তি অবশ্য গুনে ৮ টা  পেয়ে বেশ আপসেট। নিচের প্রথম ছবিটা মোরেন  লেক এর। পরেরটা ভিস্তা পয়েন্ট থেকে নেমে আসা পথের। 




এই লেক গুলোর সবাইকে একটার সাথে আরেকটাকে যুক্ত করেছে  'বো রিভার ' নামের একটা নদী। এই বো রিভার এর এখানে সেখানে আছে বেশ কয়েকটা জলপ্রপাত। তারই একটা 'বো ফলস' আমাদের পরের গন্তব্য।ছবির বাম পাশের পার্কে মানুষ প্রকৃতি দেখতে আসে আর ডান পাশের পাহাড়ের উপর আসে ক্যাম্পিং করতে।



বো ফলস এর পাশেই  পর্যটক দের অর্থ কড়ি খসানোর জন্য একটা শপিং এরিয়া সহ ছোট শহর আছে। বিকালটা শহর ঘুরে , কফি - স্মুদি খেয়ে পার করে দিলাম। পথের পাড়ে বেঞ্চে বসে সর্বনাশ করে দিল শরণ। মেঘদলের রোদের ফোটা খালি গলায় গেয়ে মাথার ভিতর ঢুকিয়ে দিল। এর পর প্রায় সপ্তা দুয়েক ধরে মাথার ভেতর শুধু ঘুরছে 

"শোনো কবি  ! শোনো  কবিতা !!
ভাঙ্গো দীর্ঘ মূর্ছনা  
রাখো এইখানে হাত টুকু 
তবু চলে যেতে বোলোনা !"


বো রিভার থেকেই আমরা আবার আমাদের লজে ফিরে যাই। সোফায় শরীর এলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পরে কেউ , কেউ খাটে। রুশদী আমি আর তাপস আজাইরা গ্যাজাইতে থাকি অনেক রাত পর্যন্ত। একটার পর একটা ট্রেন ছুটে যায় আমাদের লজের পেছনের রেলপথ বেয়ে। 




একসময় আমাদেরও তেল ফুরোয়। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাক্স পেটরা গুছিয়ে যার যার রাস্তা মাপতে থাকি। বিদায়ের সময়টা আমি সবসময় সংক্ষিপ্ত রাখতে চাই। এর যেন কোনো স্মৃতি না থাকে।


(শেষ )
জুন ৪ ২০১৫, সিনসিনাটি, ওহাইও 

Friday, May 8, 2015

চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন : রবীন্দ্রনাথ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Posted by with No comments


"সত্য কথা বারবার বললে শুনতে মিথ্যার মতন শোনায় , আর মিথ্যা কথা বারবার বললে একসময় মানুষ সেটা সত্য ভাবতে শুরু করে "
- কথাটা খুব সম্ভবত লেনিনের।  রবীন্দ্রনাথ আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এরকমই একটা প্যারাডক্স হয়ে দাড়িয়েছে ।

প্যারাডক্স খানা  গুরুতর মনে হয় তখন, যখন দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট পর্যন্ত সরব হয়ে উঠছে এই অভিযোগ নিয়ে। [১]

যখন দেখি বাংলপিডিয়ার মতন অথেন্টিক রেফারেন্সে বিরোধিতার উল্লেখ আছে। তবে সেটা মূলত স্যার আশুতোষ মুখার্জী কে নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নয়। [২]

অভিযোগের জামাতি ভার্সনটা মোটামুটি এইরকম - "১৯১২ সালের ২৮ সে মার্চ কলকাতার গড়ের  মাঠে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে একটা সভা অনুষ্ঠিত হয় যাতে রবীন্দ্রনাথ সভাপতিত্ব করেন। " [৩]

বিষয়টার দুধ কা দুধ পানি কা পানি আলাদা করতে একটু পড়াশুনা করার চেষ্টা করলাম। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে গবেষণা করেন কুলদা  রায় (আগে চিনতাম না ) তিনি প্রমান করে দেখিয়েছেন ২৮ শে মার্চ ১৯১২ তারিখে রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় ছিলেন না, ছিলেন শিলাইদহে।
[৪]

এখানে তার এই অনুছেদটা উল্লেখ করা যেতে পারে -

 ২০০০ সনে আহমদ পাবলিশিং হাউস থেকে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতা এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা’ নামে একটি বইয়ে মেজর জেনারেল (অব.) এম এ মতিন, বীরপ্রতীক, পিএসসি (তত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা) .....তিনি অভিযোগ করেন যে, রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কালি ও কলম পত্রিকার  সম্পাদক মণ্ডলীর অন্যতম সদস্য এজেড এম আব্দুল আলী একটি পত্রিকায়  এই অভিযোগটির বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, যারা রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে এই অভিযোগটি করছেন তারা তাদের রচনায় কোনো সূত্রের উল্লেখ করেন নি।  তবে ইসলামী ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত একটি গ্রন্থে এই ধরনের একটি মনগড়া অভিযোগের উল্লেখ পাওয়া যায়। মেজর জেনারেল (অবঃ) আব্দুল মতিন এই গ্রন্থ থেকেই তথ্যটি ব্যবহার করেছেন। ঐ তারিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোলকাতায়ই উপস্থিত ছিলেন না এবং তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করেন নাই। করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছরের মধ্যেই ভাষণ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ করা হত না। ১৯৩৬ সালে তাকে ডিলিট উপাধী প্রদানের বিষয়েও বিরোধিতা হত। বরং তাঁকে দুবারই মুসলমান-হিন্দু সকল শ্রেণীর ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান আন্তরিকভাবে  সম্মাননা প্রদান করেছে। সর্বোপরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার সংবাদাদি সে সময়কার পত্রিপত্রিকায় পাওয়া যায়। কোথাও রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার কোনো অভিযোগ পাওয়া যায় না। ঢাকা বিশ্বিদ্যালয়ের অধ্যাপক গীতিআরা নাসরীন জানাচ্ছেন– রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে এই  অপপ্রচারের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট বার্ষিক অধিবেশনের (২৮-২৯ জুন, ২০১১) আলোচনায় আসে।  অধ্যাপক ফকরুল আলমের কথার অংশ থেকে লিখছি…”রবীন্দ্রনাথ একসময় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বিরোধী ছিলেন….কিন্তু….চারপাঁচ বছর পর তার পুরানো পজিশন পরিবর্তন করে ফেলেছিলেন। ….অবশ্যই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে গ্রহণ করেছেন বলে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মাননায় এসেছিলেন।….যারা ইতিহাসকে এক জায়গায় রেখে দেয় তারা ইতিহাসকে বিকৃত করে, তারা সত্যকে বিকৃত করে।….” (কার্যবিবরণী, পৃ:১৭৮)।


সবগুলা রেফারেন্স একটু মনোযোগ দিয়ে পড়লেই সেইসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বাহাসের স্বরূপটা বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠে ।  তারপরও অল্প কথায় ঘটনাগুলো একটু সাজিয়ে রেখে দেই ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা অনেকেই করতেন। একেক জনের কাছে নিজের পক্ষে একেক রকমের যুক্তি ছিল।পূর্ব বঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে প্রাইমারি স্কুল বেশি দরকার বলে মনে করতেন একদল । নতুন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ফান্ড বরাদ্দ হয়ে গেলে, ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত স্কুল কলেজের এবং নির্মিতব্য স্কুল গুলোর বাজেটে টান পড়বে এই ছিল এদের শংকা। এই দলে হিন্দু মুসলমান দুই গ্রুপই ছিল। আরেক দল মনে করতেন বিশ্ববিদ্যালয় হলে এই এলাকায় শিক্ষা ও আধুনিকতার ছোঁয়া  লাগবে।সামগ্রিক ভাবে যা বাংলার এই পাশের জন্য মঙ্গল।এই গ্রুপও হিন্দু মুসলিম দুই দলের লোকই ছিলেন । সেই সময় স্বদেশী আন্দোলন নিয়ে ব্যস্ত ও ক্লান্ত রবীন্দ্রনাথ এই দুই দলের কারো হয়ে সক্রিয় ছিলেন তার কোনো প্রমান তো দুরের কথা তেমন কোনো রেকর্ডই  নাই।

আরো এক গ্রুপ ছিল যারা মনে করত  পূর্বে  হলেই মুসলমানের বিশ্ববিদ্যালয় আর পশ্চিম মানেই হিন্দুর। যুক্তি তর্কের ধার না ধারা এই দলের লোক গলার জোরের সমানুপাতে হালে পানি পায়নি। তাদের কথা কেউ মনেও রাখেনি।

যাই হোক চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করতে একটু খোজাখুজি করলাম বিষয়টা নিয়ে। কুলদা  রায় এবং এম এম জালাল সাহেব ডায়রি বা নথির কোনো ডিরেক্ট রেফারেন্স দেননি তাই  অনলাইন সংগ্রহশালাই সম্বল। বাংলাপিডিয়া তেই বেশির ভাগ ইনফরমেশন পাওয়া যাচ্ছে । ইতিহাস ঘেটেঘুটে  যদ্দুর পেলাম   -

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় মূলত বঙ্গ ভঙ্গের পরে। ১২ ডিসেম্বর  ১৯১১ তারিখে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়। ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিশ্রুতি  ছিল মুসলিম লীগের প্রথম বড় মাপের কোনো  অর্জন। সেটা ভেস্তে যাবার শংকা থেকে এ কে ফজলুল হক , নওয়াব সলিমুল্লাহ, নওয়াব আলী চৌধুরী  এবং আরো নেতারা ভাইস  রয়  হার্ডিঞ্জএর সঙ্গে দেখা করেন। ভাইস রয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে সবাইকে আশ্বস্ত করেন।

মূলত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবিরা আশংকা করেন দুইটা পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় মূলত দুই অঞ্চলকে আলাদা করে দেবে যাতে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের মূল দর্শনটাই  ব্যর্থ হয়ে যাবে। তার উপর যদি সেটা হয় শুধুমাত্র মুসলিমদের জন্য তাহলে আখেরে তা হিন্দু মুসলিম বৈরী পরিবেশ তৈরী করবে এই প্রদেশে। আরো  কারণ ছিল - বাংলার সব কলেজ তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে যদি পূর্ব পাশের কলেজ গুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়ে যায়- তাহলে বঙ্গভঙ্গ রদ করে যে বাংলাকে কোনমতে আস্ত রাখা গেল তা আবার এই এক উসিলায় তা আবার দুই মেরুতে চলে যাবে। আশুতোষ মুখার্জী এবং রাসবেহারি  ঘোষ  এর নেতৃত্বে এই দলও ভাইস রয়ের সঙ্গে দেখা করে নিজেদের আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করেন।হার্ডিঞ্জ তাদের আশ্বস্ত করলেন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে এবং এটি একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হবে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত ক্যাম্পাস বিহীন অধিভুক্ত কলেজ সর্বস্ব বিশ্ববিদ্যালয় হবে না। এরকম আলোচনা পাল্টা আলোচনা চলেছে  ছয় মাস। ১৯১২ সালের ২৭ মে তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  রূপরেখা প্রণয়নের জন্য কমিটি গঠন করা হয় যাতে রাসবিহারী ঘোষ , নওয়াব আলী চৌধুরী সহ উপরে উল্লেখিত সব দলের লোকই  ছিলেন। এই কমিটির প্রস্তাবনা অনুযায়ী ১৯২১ সালের জুলাই মাসের ১ তারিখে  কার্জন হলে অবস্থিত তখনকার ঢাকা কলেজ কে সরিয়ে দিয়ে সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা  শুরু করে।

এইসব ঘটনার কোনটাতেই রবীন্দ্রনাথের সক্রিয় কোনো অংশগ্রহনের কোনো দলিল / প্রমান নাই। কলকাতা  বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্যমান্যদের সাথে রবীন্দ্রনাথের ভালো পরিমানে উঠাবসা ছিল। তবে আদৌ ২৮ মার্চ তারিখে ঐরকম কোনো সভা হয়েছিল তারই কোনো স্পষ্ট বা অস্পষ্ট উল্লেখ কোনো সংবাদ পত্রে পাওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথ তখন নোবেল পাননি কিন্তু তিনি ততদিনে এদেশে যথেষ্ট বিখ্যাত। জমিদারির সুবাদে তার মোটামুটি প্রতিদিনের অবস্থান নথিপত্রের মাধ্যমে জানা যায়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শরতবাবু বা অন্যান্যদের সাথেও নানান বিষয়ে বচসার অনেক প্রমান আছে। তার কোনটাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত কোনো কথাই  নেই।  রবিন্দ্রনাথের  জীবদ্দশায়  কেউ কেউ তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিরধিতা নিয়ে অভিযোগ  করেননি  .তার মৃত্যুর পরও খুব সাম্প্রতিক কাল ছাড়া আগে কেউ করেছে তেমন হদিস মেলে না।আসল কথা হলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রুপের বিরোধিতার অভিযোগটাই collateral accusation এর মত রবীন্দ্রনাথের ঘাড়ে  চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এইবার সেই বিরধিতাটাই বা কেমন বিরোধিতা ছিল সেটা নিয়ে দুই কথা -ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা নিয়ে যত তর্ক বিতর্ক বা বাদানুবাদ উপরের মানুষগুলোর মধ্যে হয়েছে তাদের কারো মনেই এই অঞ্চলের কোনো সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি বিশেষ ঘৃনা ছিল না। তাদের নিজেদের জীবনের ঘটনাবলী অনুসন্ধান করলেই সেটা খুব ভালোভাবে বোঝা যাবে; সেটা অন্য জলসায় আলোচনার বিষয়। "বিরোধিতা " শব্দটার  চিরায়ত অর্থ বলতে আমরা যেমন "শত্রুতা" ভেবে অভ্যস্ত সেই বিরোধিতা ওই মানুষগুলো করেননি। যে রাসবেহারী ঘোষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার  বিরোধিতা করতে গিয়েছিলেন তিনিই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপরেখা তৈরী করলেন। এটা থেকেই কি মানুষগুলো সম্পর্কে যথেষ্ট স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায় না?

এই বিরোধীরা মূলত কেউই কারো প্রতিপক্ষ ছিলেন না। তাদের  শুধু আশংকা গুলো ভিন্ন ছিল। বিরোধীদের নেতা রাসবিহারী আর পক্ষের নেতা নওয়াব আলী এক টেবিলে বসেই বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপরেখা তৈরী করেন। কেউ বিশ্ববিদ্যালয় বাতিল হোক সেটা চাননি। তাদের বিরোধিতায় বৃহত্তর স্বার্থটাকে বড় করে দেখার প্রয়াস ছিল বলেই শত বাদানুবাদের পর তারা এগিয়েই গেছেন সবাইকে নিয়ে একসাথে। তার জন্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাতি পেয়েছিল।

নজরুলের নামে যদি বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে তবে রবীন্দ্রনাথের নামেও হতেই পারে। হিন্দুর নামে মুরারীচাঁদ কলেজ , ব্রজমোহন কলেজ, আনন্দমোহন কলেজ থাকতে পারলে রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন নয় ? আর যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতার অজুহাত দেখাচ্ছে তাদের জন্য একটাই কামনা "এদের জ্ঞান দাও প্রভু ! এদের ক্ষমা কর !!"


                                                          *************

পাদটিকা হিসেবে একটা অতি পরিচিত চুটকি :
-----------------------------------------------
দুই ভদ্রলোক শীতের দিন খুব ভোরবেলা রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। পরস্পরকে দেখে তাদের একজন ভাবছেন
- এই ভদ্রলোক নিশ্চই আমার মতন নামাজ পড়তে যাচ্ছে। আহারে শীতে কিরকম জবুথবু হয়ে আছে।
আরেক জন ভাবছে -
-হালায় শিউর আমার মতন চুরি করতে বাইর হইসে। ভাবখানা এমুন যেন কত্ত পরহেজগার।


মোরাল : একটাই  ঘটনার অনেক রকম ব্যাখ্যা হতে পারে। তবে দিন শেষে মানুষ অন্য মানুষকে নিজের মতনই ভাবে।



এইবার আসল পাদটিকা :
----------------------------
রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে আমি একটু biased . লেখায় অনিচ্ছাকৃত ভুল ত্রুটি থাকতেই পারে। ভুল ভাল থাকলে যদি কেউ ধরে দেয় মাইন্ড করব না।

টাঙ্গাইল এর জমিদার সৈয়দ নওয়াব আলি চৌধুরী 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর জগন্নাথ হল এ রবীন্দ্রনাথ




Norwood , Ohio


[১] http://www.sciy.org/?p=6791

[২] http://en.banglapedia.org/index.php?title=University_of_Dhaka

[৩] http://www.mukto-mona.com/Articles/taj_hashmi/tagore110506.htm

[৪] http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/4252