কতকাল ধরে এই এক রেষ্টুরেন্টেই পড়ে আছি। সেই সময়ের বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীদের একজন ছিলাম আমি । বিজ্ঞান প্রকল্পের "আন্ত:বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতায়" প্রথম পুরস্কারের সম্মানটা আমারই হতে পারত । আর কেউ না জানলেও আমি জানতাম, নিশ্চিত আমারই প্রাপ্য ছিল ওটা ।
প্রায় একযুগ আগের কথা- আমি তখন সবাইকে চমকে দয়ার মোহগ্রস্ত তরুন বিজ্ঞানী। পৃথিবীর সবচে বিখ্যাত গবেষনাগারে যোগ দেবার স্বপ্ন ছিল আমার। সহকর্মীরা বিশ্বাস করতেন যে আমার পক্ষে তা সম্ভব ছিল।কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। রান্নাঘরের এই জায়গাটুকুই যে কপালে বরাদ্দ ছিল।
২০২৩ সালের এক নি:সঙ্গ সকালবেলায় আর সব দিনের মতই টোস্টেড পাউরুটি চেয়েছিলাম আমার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন টোষ্টারের কাছে। যান্ত্রিক কণ্ঠে "ইয়েস স্যার " বলে শুরুও করে দিয়ছিল সে । হুকুম দিয়েই সেদিনের মত আমার প্রজেক্টের কাজ শুরু করলাম। অসাধারন একটা যন্ত্র বানিয়েছিলাম আমি। দুইরকম দুইটা জিনিসের মানসিকতা পুরোপুরি অদল-বদল করে দিতে পারত সে। নাম দিয়েছলাম 'মন রূপান্তরক' ।
আগের রাতেই মোটামুটি সব যন্ত্রপাতি জায়গামত বসানো হয়ে গিয়েছিল। এখন শুধু এর কার্যকারিতা পরীক্ষা করা বাকি। ভাবলাম রুটি টোস্ট হতে হতেই তা করে ফেলা যায়। স্পেসিমেন তৈরীই ছিল। একটা বিড়াল যোগাড় করেছিলাম আর কাটাবন থেকে এক জোড়া কবুতর। বিড়াল আর একটা কবুতরকে জায়গামত বসিয়ে সব কানেকশন চেক করে নিলাম। এক হাতে প্লেটে জেলী মাখানো টোস্ট। উত্তেজনায় মুখে দেবার কথা ভুলে গেছি। হয়তো আমার হাত একটু কাপছিলও। বোতাম চেপে চালু করে দিতেই হিসহিসিয়ে কাজশুরু করে দিল আমার 'মন রূপান্তরক' ।`আমার নিজের হৎপিন্ডের প্রতিটা স্পন্দন যেন শুনতে পাচ্ছি আমি।
অল্প সময়েই পুরোপুরি তৈরী হয়ে টার্গেট স্ক্যান করা শুরু করল 'মন রূপান্তরক'।`চোখের সামনে একটা বাচ্চা কবুতর দেখে একটু কেমন হিংস্র দেখাচ্ছে উত্সুক বিড়ালটাকে। তার সাথে যান্ত্রিক শব্দ মিশে যা হল তা বেচারা পাখিটাকে ভয় পাইয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। আমার আবিষ্কার যদি ঠিকমত কাজ করে তাহলে বিড়াল আর কবুতরকে একটু পরই পুরো উলটো ভংগিতে দেখা যাবে। ছোট্ট পাখিটাই শিকারের নেশায় হয়তো তাড়া দেবে বিড়ালটাকে । ভয় পেয়ে বিড়ালটা উড়াল দিতে চাইবে যদিও তার পাখা নেই। যেহেতু বিড়ালের শরীর হলেও মন তো তখন তার পাখির মতন। মনে মনে সে হয়তো তখন ভাববে - 'বিড়াল আমি , আমার কেন পাখির মত মন' - হা হা হা।
কতক্ষন চেয়ারে মড়ার মত পড়েছিলাম মনে নেই।কয়েক সেকেন্ডই হবে। হুঁশ ফিরে এলে নিজেকে কেমন জড় পদার্থের মত মনে হচ্ছিল। হাত পা নাড়াতে পারছিলাম না । আরে ! আমার হাত পা আছে বলে মনেই হচ্ছে না। হঠাত নিজেকে কেমন টোস্টার টোস্টার মনে হচ্ছিল। চমকে উঠলাম যখন বুঝলাম আসল কাহিনী । মন রূপান্তরক আমার সাথে টোস্টারের মন অদল-বদল করে দিয়েছে। আমার মন আটকে পড়েছে টোস্টারের ছোট চিপসেটের ভেতর। হায়! চেয়ারে পড়ে থাকা আমার শরীরে আটকা পড়েছে টোস্টারের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। রিভার্স সিকোয়েন্সে মন রূপান্তরককে আরেকবার চালু করলেই অর্থাৎ উল্টো দিকে রুপান্তর করলেই আবার আগের অবস্হায় চলে আসব আমি। আমার অংগ প্রত্যঙ্গের উপর আমার ব্রেইনের যে এখন নিয়ন্ত্রন নেই আর।কিন্তু হাল ছেড়ে দেবার পাত্র আমি নই।কিছু একটা উপায় খুঁজে বের করতেই হবে।
মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। আমি আমার নতুন শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাথে অভ্যস্ত হতে শুরু করলাম। পাউরুটি গরম করার গ্রীল, রুটি জমা রাখার ট্রে আর পরিবেশন করবার স্প্রিং মেকানিজম। আমার খুব সাধারন একটা স্ক্যানার আছে যা অনেকটাই চোখের মত কাজ করে। যদিও আমার মানবচক্ষুর তুলনায় তা কিছুই না, তারপরও আমি দেয়ালের টেলিফোনটা দেখতে পারছিলাম। আমি রুটি ছুড়ে মারতে শুরু করলাম ওটার দিকে। উদ্দেশ্য হোটেলের ইন্টারকমে একটা সংযোগ পাওয়া। একের পর এক আমার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে লাগল। আরেকটা বুদ্ধি এল মাথায়- রুটি ছুড়ে দেয়ার আগে টোষ্ট করে নেয়া যায়। তাই করতে লাগলাম; মনে হচ্ছে এবার কাজ হবে; হলোও তা । এবার 'জিরো' বাটনে চাপ দিতে পারলেই হয়ে যায়।
অবিরাম চেষ্টায় অবশেষে হোটেল রিসেপশনে সংযোগ পেলাম।
-" হ্যালো।"
-" হ্যালো। রুম 1921 থেকে বলছি। রুম সার্ভিসের কাউকে পাঠাতে পারবেন ? আমার একটু জরুরী দরকার।" নিজের কন্ঠ কেমন নিজের কাছেই অদ্ভুৎ ঠেকছিল।
- "অবশ্যই স্যার। 5 মিনিটে মধ্যে কেউ পৌছে যাবে।"
রুম সার্ভিস বেশ দ্রুতই এল।
আমার যান্ত্রিক স্বরে বললাম -" আমি ইনটারকম থেকে বলছি। আপনার সামনে যে যন্ত্রটা রাখা আছে ওটার স্টার্ট বাটনটা চাপুন।"
ভদ্রলোক একটু অবাকচোখে চারদিক তাকিয়ে এরপর বাটনটার কাছে হাত এনে বলল - "এটা ? "।
- "হ্যাঁ। তার আগে ...."
আমার কথা শেষ হবার আগেই পুরো ঘর উজ্জ্বল আলোয় ভরে গেল; ধপ করে পড়ে গেল সে । একটু পর উঠে দাঁড়াল আর ভু'উম!ভু'উম !!ভু'উম!!! করতে করতে ঘরময় পায়চারী করতে শুরু করল সে। আমার সকল প্রচেষ্টার এমন সলিল সমাধি দেখে আমি হতাশ। এমন সময় হঠাৎ সার্ভিসম্যানের কি মনে হল । সে দুই হাত পাখির ডানার মত নাড়তে নাড়তে জানালার দিকে ছুট দিল। জানালা দিয়ে যখন সে লাফ দিল আমার যান্ত্রিক কন্ঠ দিয়ে যে স্বর বেরুল তা কিভাবে বলে বোঝাবো তা বুঝতে পারছি না। আর আমার কবুতরটা এখন দুই পাখা সটান পিঠে নিয়ে খুবই ধীর গতিতে হেঁটে বেড়াতে লাগল।
হাল ছেড়ে দেবার মানুষ আমি নই। কিন্তু লোকটার মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী না করে পারছিলাম না। আমার সামান্য অসতর্কতার খেসারত একা আমিই শুধু নই , নিরীহ লোকটাকেও প্রান দিয়ে দিতে হল। কিছু না পেয়ে আমি বিড়ালটার দিকে পাউরুটি ছুড়ে দিলাম... রুটি পুড়িয়ে নানারকম সাহায্য চেয়ে বার্তা ছুড়ে দিতে লাগলাম জানালা গলিয়ে। পাউরুটির স্টকও একসময় ফুরিয়ে গেল।
আমাকে চমকে দিয়ে আমার আসল শরীর হঠাৎ উঠে দাড়াল। আমার টোষ্টারসুলভ শরীরের দিকে তাকিয়ে তার চোখে খুশির ঝিলিক দিয়ে গেল। সমস্বরে বলে উঠল -
- "'I have been upgraded "
শুনে আমি পুরা থ । সে আরো বলে কিনা - "Would you like some toast? "
আবারো আশায় বুক বাধলাম আমি। আমি টোষ্টারটাকে (যে কিনা আমার আসল শরীরটাকে এই মুহূর্তে নিয়ন্ত্রন করছে) বললাম- " আমার এখন তোমার সাহায্য চাই"।
সে জবাবে বলল - "তেলে ভেজে দেব?"
উপায়ান্তর না পেয়ে ওকে যে কোন ভাবে বোঝালাম নিচতলায় কাউকে এখানকার অবস্থা কিভাবে বলতে হবে। সে দুই পায়ে লাফাতে লাফাতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মনে হল সিঁড়িতে হোচট খেল সে । তারপর নিচ পর্যন্ত গড়িয়ে পড়ার শব্দ। তারপর মিনিট যায় , ঘন্টা যায় .... আমি আমার দুর্ভাগ্যের উপর নিজেকে সপে দিতে থাকি। আমার এবার ধৈর্য্যের বাধ ভাঙে। আমি নিজের মৃত্যুদৃশ্য আঁকতে শুরু করি। ফুল পাওয়ারে গ্রীল গরম করা শুরু করলাম। উচ্ছিষ্ট রুটি পুড়ে ঘর ধোঁয়াময় হয়ে উঠল। ফায়ার এলার্ম বেজে উঠল একসময়।
ফায়ারম্যান এসে সেদিন আগুন নিভিয়েছিল। আমাকে পাঠিয়ে দেয়া হল একটা মেরামতি দোকানে। দোকানের মেকানিক আমার কলকব্জা খুলে পরিষ্কার করে আবার জোড়া দিল। আমার ভয়েস চিপ ( যেটার সাহায্যে আমি কথা বলতাম) -টা সে মেরামত করতে পারে নি। শোকেসে সাজিয়ে রেখেছিল সে আমাকে। আটশ পচাত্তর টাকা দিয়ে এক রেষ্টুরেন্ট মালিক কিনে নেয় মানুষের বুদ্ধিসমেত এক টোষ্টার। আমার জায়গা হয়েছে তার বিশাল রান্নাঘরের একটা প্রান্তে। ইলেক্ট্রনিক ভয়েস হারিয়ে আমি সবার দৈনন্দিন জীবনের নানাবিধ গল্প শুধু শুনেই যাই; বলতে পারি না কিছুই। এই তো আজকেই দুইজন গল্প করছিল নতুন একজন বাবুর্চীকে নিয়ে।খুবই নাকি অদ্ভুৎ তার আচার আচরন আর কথা বার্তা। এমন সময় দরজা দিয়ে তাকিয়ে দেখি আমারই পুরনো সেই শরীর সেখানে হাসি হাসি মুখে দাড়িয়ে আছে।সে-ই এখানে নতুন বাবুর্চী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে।
আজকে মেন্যুতে দুটো নতুন আইটেম যোগ হয়েছে- 'ফ্রেঞ্চ টোষ্ট' আর 'বাটার্ড বেগেল'।
-- শেষ --
মূল- Matthew Grigg's "Professor Panini" অবলম্বনে
সেপ্টেম্বর 26 , 2013
September 26, 2013